শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৫ চৈত্র ১৪৩০ || ১৭ রমজান ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ইটের পর ইট মাঝে মানুষ কীট

শারফিন শাহ

২৩:০৩, ৫ মে ২০২১

আপডেট: ১৩:০৯, ৯ মে ২০২১

১৯৬৩

ইটের পর ইট মাঝে মানুষ কীট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যে স্থানটিতে সবচেয়ে বেশি অবসর কাটিয়েছি সেটি হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সারি সারি গাছের নিবিড় নীলিমা, পাখপাখালির মধুর কলরব আর ঘাসের গালিচায় শোভিত এই উদ্যান যেন নগরবাসীর জন্য এক টুকরো স্বর্গ! 

হলের বন্ধুরা সদলবলে ভোর হতেই হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম ওই স্বর্গভূমিতে। পুরো উদ্যানে দৌড়ে শরীরের মেদ ঝরিয়ে হালকা হয়ে ফিরতাম সানন্দে। সারাদিন একটা প্রশান্তির ঢেউ বয়ে যেতো সবার মনে। কখনো প্রিয় শিক্ষক, কবি, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীদের সাথেও দেখা হয়ে যেতো। আড্ডাও জমে যেতো কারও সাথে। একবার তো কবি নির্মলেন্দু গুণকেও পেয়ে গেলাম। আমি তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—' আরে গুণদা! আপনি এই সাত সকালে এখানে যে!' গুণদা বললেন, ' কাব্যের খোঁজে এসেছি বৎস! ড্রয়িং রুমে বসে তো আর কাব্য হয়না, তাছাড়া ঢাকা শহরে এই উদ্যানের মতো মুক্তাঙ্গন আর কোথাও কী আছে? এখানেই বাস করে কাব্য সরস্বতী!' 

গুণদার কথায় সেদিন মনে হয়েছিল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কাব্যভূমিও বটে। তা না হলে এখানেই কেন রচিত হবে বঙ্গবন্ধুর সেই সাতই মার্চের ভাষণের অমর কাব্য? এখানেই কেন পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করবে? এখানেই কেন স্বাধীনতার শিখা প্রজ্বলিত হবে? এই উদ্যান শুধু স্বস্তির উৎসই নয়, কালের সাক্ষীও। 

কিন্তু ইতিহাসের ক্যানভাসে মনোহর ছবি হিসেবে অঙ্কিত হলেও কালের করাল গ্রাসে এই উদ্যান আজ শ্রীহীন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সম্প্রতি এখানে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে শুরু হয়েছে অর্ধশতকী গাছ কাটার নিষ্ঠুর উৎসব। করাতকলের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে গগন শিরিষ, অশোক, জারুলের মতো গাছ। গগন শিরিষ গাছের ডালে যে সোনালী ডানার চিল বসতি গড়েছিল তাও মুহূর্তেই উড়ে গেছে! আরও অনেক পাখিরাও উদ্বাস্ত হয়ে পড়েছে গাছ নিধনের অপতৎপরতায়।

এরকম প্রকৃতিবিনাশী আয়োজন পৃথিবীর আর কোথাও করা হয় বলে জানা নেই। বদরুদ্দীন উমর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, অক্সফোর্ডে পড়ার সময় তিনি দেখেছিলেন কীভাবে একটি গাছ কাটার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়েছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই। তিনি পড়াশোনা শেষ করে ফিরে এসে তিরিশ বছর পর আবার সেখানে গিয়ে দেখেন গাছটি ঠিক আগের জায়গাতেই আছে! আর আমরা দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানায় নির্বিঘ্নে গাছ কেটে ফেলা হলেও সম্মিলিতভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছ কাটার প্রতিবাদ করলে হয়তো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছগুলো বেঁচে যেতো।

ইংরেজরা জঙ্গল কেটে অপূর্ব নৈপুণ্যে গড়েছিলেন ছবির মতো সুন্দর রমনা উদ্যান আর রেসকোর্স ময়দান। নবাবরা পুরো এলাকাটিকে আরও সাজিয়ে গুছিয়ে নামকরণ করেন শাহবাগ বা 'রাজকীয় বাগান'। সেই সময় একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে নামমাত্র পরিকল্পনা নিয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থের জন্যে নিরীহ গাছ সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এখানে সাতটি রেস্তোরাঁ করা হবে দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে। ঢাকার অলিতে গলিতে রেস্তোরাঁর অভাব নেই। চোখ মেললেই রেস্তোরাঁ মিলবে, কিন্তু উদ্যান তো সেভাবে মিলবে না। এখানে যারা আসবেন তারা তো খেতে আসবেন না। তারা আসবেন ইতিহাসের রসাস্বাদনের তাগিদে। তবে, কেন এই সবুজের বুকে দগদগে ক্ষতের চিহ্ন জুড়ে দেওয়া? পৃথিবীর আর কোন দেশ হলে এখানে আরও সৌন্দর্যবর্ধক গাছ রোপণ করে রূপ সঞ্চার করা হতো। আর আমরা করছি তার উল্টো! 

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন গাছপালার প্রতি অনুরক্ত এক কবি। গাছ কাটা দেখলে তিনি মোটেও সহ্য করতেন না। ঠাট্টা করে বলতেন, পরেরবার জন্মালে ফরেস্ট অফিসার হয়ে জন্মাব, কাউকে গাছ কাটতে দিবনা। গাছ ও প্রকৃতির প্রতি নগরবাসীর নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করে তিনি ব্যথিত হতেন। কখনও কবিতায় সেই খেদ ঢেলে দিতেন এভাবে : 
'ইটের পর ইট
মাঝে মানুষ কীট
নাইকো ভালোবাসা 
নাইকো খেলা।'
প্রকৃতির প্রতি যে আমাদের ভালোবাসা নেই, প্রকৃতির ছায়াতলে আমাদের কোমলমতি শিশুদের খেলার ব্যবস্থা যে আমরা করতে অনিচ্ছুক, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত  ঢাকা শহরের ফুসফুস সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওপর এরূপ দানবীয় আক্রমণের ঘটনা! আমাদের প্রার্থনা থাকবে, এই নিষ্ঠুরতা যেন অচিরেই বন্ধ করা হয়।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank