বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ || ৫ বৈশাখ ১৪৩১ || ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

৫৬ হাজার বর্গমাইল দৈর্ঘ্যের স্বপ্ন

কবির য়াহমদ, সাংবাদিক ও লেখক

০৫:৫৭, ১১ ডিসেম্বর ২০২০

১১২৪

৫৬ হাজার বর্গমাইল দৈর্ঘ্যের স্বপ্ন

সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মত অবকাঠামো নির্মাণ করে ফেলেছে বাংলাদেশ। পদ্মার দুই পাড়ের স্বপ্নসম সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। সেতুর ৪১তম স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে স্বপ্ন নেমে এসেছে ধুলোর ধরার। পদ্মাসেতু এখন আর স্বপ্নে সীমাবদ্ধ নেই, এটা এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। সেতু যান চলাচলের উপযোগী হয়ে ওঠবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই। তবে সর্বশেষ এই স্প্যান বসানোর মাধ্যমে পদ্মার দুই পাড়ের স্বপ্নের সংযোগ স্থাপন হয়ে গেছে; রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯টি জেলা।

পদ্মাসেতু আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরির কথা ছিল না। কথা ছিল বিশ্বব্যাংকসহ বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর অর্থায়নে হবে এই সেতু। কিন্তু ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে পদ্মাসেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের ওই সিদ্ধান্তের পর অনেক জল ঘোলা হয়েছে। সেতু নিজস্ব অর্থায়নে করা সম্ভব কি না এনিয়ে দেশে অনেক বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কারণে বাংলাদেশ এই অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছে।

পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ নিয়ে কানাডার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিন ও বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ তোলে বিশ্বব্যাংক। এ নিয়ে কানাডার আদালতে মামলা হয়। পাঁচ বছরের বেশি সময়ের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৭ সালে কানাডার আদালত মামলাটি খারিজ করে দিয়ে রায়ে জানায়, এই মামলায় যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে তা মিথ্যা, অনুমানভিত্তিক। বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট বি জোয়েলিক তার দায়িত্বের শেষের দিকে বাংলাদেশের বৃহৎ এই প্রকল্পে দুর্নীতির যে অভিযোগ আনেন সেখানে যাদের দিকে তীর নিক্ষেপ করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ও পদ্মাসেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজর ড. মসিউর রহমান, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। এদের মধ্যে ড. মসিউর রহমান ও আবুল হোসেনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল, মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের পর গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে তাদের সবাইকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়াও হয়। পরে কানাডার আদালতের রায়েও এই সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগকে ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়।

বিশ্বব্যাংক ছাড়াও এই সেতুতে অর্থায়নের কথা ছিল এডিবি, জাইকা এবং ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের। কিন্তু কল্পিত অভিযোগের পর তারাও একে একে সরে যায়। মালয়েশিয়ার অর্থায়নের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন জেদ কিংবা আন্তরিকতায় সিদ্ধান্ত হয় নিজেদের টাকায় পদ্মাসেতু করার। এখানে আবুল মাল আবদুল মুহিত রাখেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। দাতারা সরে যাওয়ার পর এবং বিশ্বব্যাংক কর্তৃক দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণের আগেই ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি খুঁটির উপর বসেছিল ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এর তিন বছরেরও বেশি সময় পর বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) মূল সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারে ৪১তম শেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে ৬.১৫ কিলোমিটারের পদ্মাসেতু। জানা যাচ্ছে, সেতুর ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্লাবের মধ্যে ১ হাজার ৪১টির বেশি রোড স্ল্যাব বসানো হয়েছে। আর ২ হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে এখন পর্যন্ত বসানো হয়েছে ১ হাজার ৫০০টির বেশি। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বহুমুখী এ সেতু হবে দোতলা। পদ্মাসেতুর মূল কাঠামো স্টিলের। এই স্প্যানের ওপর কংক্রিটের প্রলেপ দিয়ে রাস্তার কাঠামো তৈরি হবে।

প্রমত্ত পদ্মার বুক চিঁরে গড়ে ওঠা এই সেতু স্রেফ এক সেতুই নয়, এটা দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র, অবিশ্বাস, অপবাদ, অভিযোগের বিপরীতে বাংলাদেশের সক্ষমতার এক স্থিরচিত্র। বিশাল এই কর্মযজ্ঞের অর্থের সংস্থান একটা সময়ে কষ্টকল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও সেটা এখন আর নেই। পদ্মার দুই পাড়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মত এই সময়ে অসম্ভব শব্দটা অভিধানে রেখে বাস্তবতায় অন্য চিত্র দেখাতে উদগ্রীব বাংলাদেশ। এখানে জেদ আছে, সক্ষমতা প্রমাণের ব্যাপার আছে, আছে নিজেদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও। ৬.১৫ কিলোমিটারের সেতু তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রমাণের একটা স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে পদ্মার বুকে।

এই সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল থেকে সর্বমহলে সামর্থ্য বিষয়ক অবিশ্বাসের যে বীজ মহীরুহ হয়ে ওঠেছিল সেটা এখন দৃশ্যত হাওয়া। সফলদের সাফল্যের পূজা করে মানুষ। এখানে সফল বাংলাদেশ, আর সাফল্যে নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এটা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা দৃঢ়তার আর বাংলাদেশের সক্ষমতার এক উদাহরণ। এই সক্ষমতা আনন্দের, এই সক্ষমতা আশাবাদের; নেতৃত্ব উদ্দীপনার।

এটা সময়ে পদ্মাসেতু ছিল স্বপ্নের মত। এখন সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপলাভ করেছে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ পরিক্রমায় যে ৪১ স্প্যান বসেছে সেগুলো ২৯ জেলার কোটি মানুষের স্বপ্ন। দৈর্ঘ্যে এই সেতু ৬.১৫ কিলোমিটার সত্য, কিন্তু ওই অঞ্চলসহ সারাদেশের মানুষের এই স্বপ্নের দৈর্ঘ্য ৫৬ হাজার বর্গমাইলেরও অধিক। কারণ এটা কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনকে বদলাবে না, বদলাবে সারাদেশের মানুষের স্বপ্ন ও মানসিকতাকে; সারাদেশ নিজেদের সক্ষমতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠবে।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank