শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৫ চৈত্র ১৪৩০ || ১৭ রমজান ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

এমন নিঃশব্দ, স্তব্ধ, অচঞ্চল সকাল আর চাই না!

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

১২:১০, ২৯ জুলাই ২০২০

১৫৪৫

এমন নিঃশব্দ, স্তব্ধ, অচঞ্চল সকাল আর চাই না!

সকালবেলা চা খেতে খেতে হঠাত বাইরের দিকে তাকিয়ে স্ত্রী বললেন, ‘কী সুন্দর একটি ঝকঝকে সকাল- অথচ একটুও আর সুন্দর লাগছে না! সকালের সৌন্দর্য আসলে কর্মচাঞ্চল্যে!’ কথাটি ভাবিয়ে তুললো। সত্যিই তো‍! একটি সকালের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে মানুষের কর্মচাঞ্চল্যে! নগর জীবনের এটাই নিত্য চেহারা। সকালবেলা অফিসমুখী মানুষগুলোকে দেখতেও খুব ভালো লাগে। সবচেয়ে ভালোলাগে তাদের ত্রস্তপায়ে হাঁটা। 

পৃথিবীর অপরপীঠে নিউইয়র্ক শহরেই দেখেছি এর সবচেয়ে সেরা দৃশ্যপট। সেটাই আগে বলি। ম্যানহাটন নিউইয়র্কের প্রাণকেন্দ্র। বলা চলে কর্মমুখর পৃথিবীরই প্রানকেন্দ্র এটি। কেন বলছি?- কারণ পৃথিবীর নিউক্লিয়াস যদি হয় নিউইয়র্ক। তাহলে নিউইয়র্কের নিউক্লিয়াস এর ম্যানহাটন। আর ম্যানহাটনের নিউক্লিয়াস এর টাইমস স্কয়ার। কংক্রিটের তৈরি গ্লাস অ্যান্ড লাইটসের এক চোখজুড়ানো দৃশ্যপট। সেই টাইমস স্কয়ারকে ঘিরে তার মাটির নিচের অংশ রয়েছে ১২১টি ট্রেন স্টেশন। ফিফথ এভিনউ-ফিফটিথ্রি স্টেশন, থার্টিফোর্থ স্ট্রিট-হাডসন ইয়ার্ডস, সেকেন্ড এভিনিউ, সিক্সথ এভিনিউ, এইটথ এভিনিউ, ব্রডওয়ে লাইন, ফোর্টিসেকেন্ড স্ট্রিট, রোকেফেলার সেন্টার সাবওয়ে স্টেশন এমনসব নাম।
 
এরমধ্যে ফোর্টিসেকেন্ড স্ট্রিটে ভীরটা বেশি থাকে। এখান থেকে সহজেই বের হয়ে আসা যায় টাইমস স্কয়ারে। এছাড়া আন্ডারগ্রাউন্ডের এই পথটি ধরেই যেতে হয় পাশেই পোর্ট অথরিটি বিল্ডিংয়ে। সেখান থেকে ছাড়ে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে যাওয়ার বড় বড় বাসগুলো। স্টেশনটি পাতালদেশে ছয় কিংবা সাততলা গভীর। একেকটি স্কেলেটর, একেকটি স্টেয়ারকেস, লিফট কানায় কানায় ভরে থাকে প্রতিটি সকাল। কর্মমুখী মানুষ যেমন ঘরে ফেরে, বলা হয়- নিউইয়র্ক নেভার স্লিপস, রাতেও জেগে থাকা শহরে রাতের শিফটে কাজকরা মানুষগুলোও ঘরে ফেরে- সে কারণে আপ-ডাউন দুটি পথই থাকে সমান সচল। 

তাছাড়া- এই ম্যানহাটনে যেমন মানুষ কাজে আসে- তেমনি এখানে যারা বাস করেন- বলা হয়, ২২ বর্গমাইলের ম্যানহাটন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহরাংশের একটি। যেখানে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ মানুষের বাস। তারাও কেউ কুইন্স, কেউ ব্রংকস, কেউ ব্রুকলিনের পথে ছোটেন। কেউ কেউ অদূরের নিউজার্সি স্টেটেও যান। কাজে যাওয়ার তাড়ায় থাকা মানুষগুলো লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটতে থাকে। কী নারী কী পুরুষ, কী যুবক, কী বয়ষ্ক- কী শ্বেতাঙ্গ, কী কৃষ্ণাঙ্গ, হিসপানিক, মেক্সিকান, চায়নিজ, এশিয়ান কিংবা খোদ আমেরিকান- সব দেশ-জাতি-বর্ণ-ধর্ম-গোত্রের মেল্টপটে জমে থাকা মানুষগুলো সকালে কাজের অভিমুখে যে ছুট দেয় সেটাই বোধহয় সকালের সেরা সৌন্দর্য।

ঢাকায় ফিরি। এই যে ঢাকা- সেও এক কর্মচঞ্চল শহর। আমাদের হয়তো ম্যানহাটনের মতো গোছানো কোনও স্টেশন নেই। নেই সাবওয়ে। নেই পরিকল্পিত স্ট্রিট কিংবা এভিনিউ। হচ্ছে সবে। তবে মানুষ আছে। সারা দেশ থেকে জীবিকার সন্ধানে রাজধানীতে এসে জমে থাকা মানুষগুলো প্রতিটি সকালে কর্মমুখী হয়। ফলে এখানকার সড়কগুলো ভরে থাকে গাড়িতে। কেউ বাসে, কেউ টেম্পুতে, কেউ অটোরিক্সায়, কেউ প্রাইভেট কারে, কেউ মোটরবাইকে, কেউ আবার পায়ে হেঁটেই ছোটে নিজ নিজ কাজে। সড়কগুলোতে গাড়ির হর্ন বাজতে থাকে। তাতে শব্দদুষণ হয় বটে, কিন্তু প্রতিটি হর্নেই থাকে দ্রুত কাজে যেতে হবে, আমায় পথ ছাড়ো— এমন তাড়ার স্পষ্ট প্রকাশ। 

বিশেষ করে ঘড়ির কাঁটা সকাল ৮টা ছোঁয়ার আগেই দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী ঢুকে পড়েন যে যার কারখানায়। ঢাকার আশেপাশে ও ইপিজেডগুলোয় গড়ে ওঠা সেসব কারখানার পথে শ্রমিকদের ত্রস্ত পায়ে হেঁটে যাওয়ার সে দৃশ্য ম্যানহাটনের সেই দৃশ্যের চেয়ে কম সুন্দর নয়। নানান রঙের নানার ছাপার কাপড় পরে আমাদের গার্মেন্টস কন্যারা দুপুরের খাবার নেয়া টিফিন ক্যারিয়ার হাতে  ঢুকে পড়েন যে যার কারখানায়।

অনেক মানুষ এখন ঢাকার অদূরে গাজীপুরে থাকেন। তারা ভোরে ঢাকায় ফেরা ইন্টারসিটি ট্রেনগুলোয় উঠে পড়েন। গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে তারাও এসে নামেন হয় বিমনবন্দর, নয়তো কমলাপুর স্টেশনে। সেখান থেকে দ্রুত ছোটেন যে যার কর্মস্থলে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের দিকে মানুষ ছুটতে থাকে হন্যে হয়ে।
 
ঢাকায় উবার-পাঠাও এসব রাইড শেয়ারিং চালু হওয়ার পর মোটরবাইকের দৌরাত্ম্য নিয়ে অনেকেই অখুশি। কিন্তু এটা এখন এক অতি সহজলভ্য দ্রুতযান হয়ে উঠেছে কর্মমুখী মানুষের জন্য। ফলে প্রতিটি সকালে রাজধানীর মোড়ে মোড়ে, জমাট বেঁধে থাকা গাড়িগুলোর মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে শতশত যাত্রিবহনকারী মোটরবাইক সিগন্যাল পয়েন্টের সামনে এসে দাঁড়ায়। সিগন্যাল ছাড়ার অপেক্ষায় থাকে। আর সবুজ বাতি জ্বললে, কিংবা ট্রাফিক পুলিশের ইঙ্গিত পেলেই দে ছুট। সে ছোটা যে কেবল যাত্রীকে দ্রুত কাজে পৌঁছে দেয়ার তাগীদে, তা নয়। চালক জানেন, দ্রুত ফ্রি হতে পারলে এই সকালেই হয়তো আরও একটি ট্রিপ তিনি পেয়ে যাবেন। তাতে বাড়বে দিনের আয়। ফলে এই তাড়াতেই তার কর্মচঞ্চলতা। এই তাড়াতেই তার জীবিকা। 

নগর জীবনে এসবই সকালের সৌন্দর্য। শুধু ঢাকা কিংবা নিউইয়র্ক কেনো। পৃথিবীর সকল বড় বড় শহরের একই চিত্র একই দৃশ্যপট। গোটা বিশ্ব আজ থমকে আছে। কী বেইজিং কী দিল্লি, কী করাচি, কী বার্লিন, কী লন্ডন কী টোকিও- সব। কোথাও নেই কর্মচঞ্চল সকাল। অথচ ভোরের আলো ফোটে সেই একই রকম। হয়তো একটু বেশিই উজ্জ্বল হয়ে ফোটে সে আলো। মনুষ্যসৃষ্ট সকল ধরনের দুষণ বন্ধ থাকায়- হয়তো সকালগুলো আরও নির্মল, আরো শান্ত। কিন্তু এমন নিঃশব্দ, স্তব্ধ, অচঞ্চল সকাল আমরা চাই না। কারণ প্রকৃতিকে শান্ত করে রেখে, পৃথিবীটাকে স্তব্ধ করে দিয়ে, একটি ঘাতক ভাইরাস আজ পৃথিবীময় তার রাজত্ব বিস্তৃত করে একে একে কেড়ে নিচ্ছে মনুষ্যপ্রাণ। সুন্দর সুন্দর সকালগুলোতেও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে ভাইরাসের হানায় ফুসফুস বিকল হওয়া মানুষগুলো। ঢাকার সড়কগুলোতে অ্যাম্বুলেন্সের ভেঁপু ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। এ কোন মৃত্যুপুরী! 

হ্যাঁ প্রকৃতির দেওয়া শিক্ষা থেকে আমাদের অন্তত এটা বুঝে নিতে হবে, প্রকৃতির ওপর অত্যাচারেরই প্রতিশোধ এসব। সে শিক্ষা বোধ হয় গোটা পৃথিবীরই হয়ে গেছে। এবার   পৃথিবী ফিরুক তার প্রতিদিনকার রোটিনে। সকালগুলো হোক কর্মচঞ্চল। দুপুরগুলো থাকুক কর্মমুখর। স্বাভাবিক সন্ধ্যা নামুক। রাতগুলো থাক শান্ত ও নির্মল। তবে সে কাজ যেনো পৃথিবী নামের গ্রহটিকে আর কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে না ঠেলে দেয় সে চেষ্টা মানুষকে এখন থেকে করতেই হবে। যার কোনো একটি বিকল্পও আর সামনে থাকছে না। 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank