শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ || ৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

করোনাকালের কথকতা

আমিনা রিংকি, শিক্ষক, ঢাবি

২০:১৭, ২৫ জানুয়ারি ২০২১

আপডেট: ২০:৫০, ২৫ জানুয়ারি ২০২১

১৪৭০

করোনাকালের কথকতা

আমিনা রিংকি
আমিনা রিংকি

যখন মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে, জমি কেনা-বেচা শুরু হয়েছে মহাকাশে, যখন মানুষ চোখের নিমিষে পাড়ি দিতে যাচ্ছে হাজার হাজার মাইল - তখন মানুষ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কাছে পরাজিত হবে এটা কল্পনাতীত ব্যাপার ছিল।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি আমাদের মনে বদ্ধমূল একটা ধারণা প্রোথিত করে দিয়েছিল যে- এ রকম কোন রোগ হয়তো হবে না যার কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা থাকবে না। অথচ গত এক বছর ধরে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ জীবন বাচাঁনোর তাগিদে দিনের পর দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। যে সময়ে পৃথিবীতে বার্ষিক পর্যটন শিল্পের আয় ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার, প্রতি মুহূর্তে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, যখন ঘরের খাবার অপেক্ষা রেস্টুরেন্টের খাবার অতি উপাদেয়, সে সময় আমরা এক অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে জবুথবু হয়ে আছি। এশিয়া থেকে আফ্রিকা, ইউরোপ থেকে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া থেকে এন্টার্কটিকা- পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে এ ঘাতক ভাইরাস। এক বছরের ব্যবধানে পৃথিবীতে ২১ লাখ মানুষ হারিয়েছেন।

মহামারির নির্মমতার ভয়াবহতায় শিউরে উঠছে মানুষ। ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে তবে কার্যকর ভ্যাকসিন পেতে ও সেই ভ্যাকসিন সহজলভ্য হতে এখনো ঢের দেরি।  
যোশেফ স্ট্যালিন বলে গিয়েছিলেন-   A single death is a tragedy, a million deaths are a statistic.

করোনা মহামারি আমাদের চারপাশ থেকে আপনজনদের জীবন প্রদীপ নীরবে নিভৃতে নিভিয়ে দিচ্ছে। শুধু কি জীবনের মৃত্যু? করোনাকালে আর্থিক অসংগতি হাজার হাজার মানুষের স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটিয়েছে- এখবর আমাদের কতজনের জানা? কারণ প্রতিদিন অনেক খবর আসে সংবাদপত্রের পাতা ভরে কিন্তু জীবন খাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে।
           
আমাদের জীবনে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এত ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে আমরা কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি কোন একঘোর অমানিশার প্রাক্কালে দিনের পরদিন আমাদের অর্থনৈতিক,  সামাজিক,  সংস্কৃতিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো দিনের পরদিন স্থবির হয়ে থাকবে। শ্লথ হয়ে যাবে অর্থনীতির চাকা, থেমে যাবে উন্নয়নের জয়রথ। করোনাকালের প্রথম ঢেউয়ে একটা দীর্ঘসময় পর্যন্ত সবকিছু বন্ধ ছিলো- পরবর্তীতে নিউ নরমাল লাইফের সাথে তাল মিলিয়ে সব কিছুই এখন চলছে সমানতালে। শুধু কোথায় যেনো একটু ছন্দপতন!  যে পরিবারগুলোতে করোনা থাবা বসিয়েছে শুধু উনারা জানেন প্রিয়জন হারানোর কষ্ট! 

আরও কিছু মানুষ আছেন যারা জানেন করোনা কতটা নির্মম! ভাবতে পারেন উনারা কারা? আমাদের চারপাশে নিঃশব্দে যাদের বিচরণ।যাদের আমরা কেতাবি ভাষায় নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত বলে থাকি। উন্নয়নের কোন সূচকে যাদের আমরা দেখতে পাইনা। প্রবৃদ্ধির অংকগুলো তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করতে পারেনা। একদিকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ আমাদের করোনাকালে সর্বোচ্চ ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে,  অন্যদিকে লকডাউনে দিনের পরদিন বন্ধ থেকে বিদ্যালয় বিক্রি হবার বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে মিডিয়াগুলোতে। ঢাকা শহরে যে মানুষগুলো একরুম অথবা দু'রুমের বাসায় পরিবার পরিজন নিয়ে দিনাতিপাত করতেন, তারা সবাই তল্পিতল্পা গুটিয়ে গ্রামেরবাড়িতে নিজেদের শিকড়ে ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু কেন?       

এলাকার ছোট্ট টং দোকানদার বা আপনার বাসার নিয়মিত মাছওয়ালা/সবজিওয়ালা কিংবা ঘরের কাজ করার জন্য সাহায্যকর্মী - এই মানুষ গুলোর খোঁজ নিয়েছেন? অথবা আপনার প্রতিষ্ঠানের দারোয়ান বা ড্রাইভার, কিংবা ফুটফরমায়েশ করার জন্য যে মানুষটা থাকতো সে মানুষগুলো ভালো আছে তো? বেঁচে আছে তো? 

থাকুক ওসব কথা - আরো  নিবিড়ভাবে চিন্তা করুন- আপনার সন্তানের গৃহশিক্ষক/ শিক্ষিকা, নাচ/গান শেখানোর গুরুজী কিংবা ধর্ম শিক্ষক এই মানুষগুলো এখনো কি আছে?  নাকি হারিয়ে গেছেন?    

করোনা মহামারি আমাদের দেশে খুব একটা ক্ষতি বৃদ্ধি করতে পারে নাই- বটে! শুধু প্রায় ৮ হাজার মানুষ চলে গেছেন না ফেরার দেশে গত ১০ মাসে।আঠারো কোটি জনসংখ্যার দেশে এটা নিতান্তই ছোট্ট একটাসংখ্যা, তাছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় গড়পড়তা আমাদের দেশে এর চেয়ে বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে- এটা ভেবেই আমরা শ্লাঘা অনুভব করছি। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের তুলনায় যদিও আমাদের মৃত্যুহার কম - তারপরেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল আশু থামবে না। 

ভ্যাকসিন নিয়ে চলছে তুলকালাম কান্ড। কার্যকারিতা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। সেই সাথে জমে উঠেছে ভ্যাকসিন কূটনীতি।সবচেয়ে স্থবির হয়ে গেছে আমাদের শিক্ষা খাত। লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের ভাগ্য আশা নিরাশার দোলাচলে দোদুল্যমান।অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে কিন্তু প্রাথমিক আর মাধ্যমিকের ৬৯ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে। ৭৫ ভাগ শিক্ষার্থী দ্রুত স্কুল খোলার পক্ষে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবস্থা আরো নাজুক। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান, ডিভাইস সংকট, অর্থনৈতিক সংকট, ইন্টারনেট সংযোগের অভাব অথবা ধীর গতি সব মিলিয়ে মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আছে চাকুরিপ্রার্থীদের জীবনথেকে একটা বছর হারিয়ে যাওয়া।
   
করোনাকালে যদিও আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, তথাপি কমে গেছে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। ২০১৯ সালে যেখানে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.১৫ শতাংশ, করোনাকালে ২০২০ আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৫.২৪ শতাংশ।  তারপরেও ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা "সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের " World Economic League Table- 2021 অনুযায়ী- বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি।সুতরাং আশার আলো এখনো জাজ্বল্যমান। করোনা মহামারি আমাদের আবারো চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাদ্য আর চিকিৎসা, বাদবাকি সব গৌণ। আর করোনাকালে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্হার ভগ্নদশা আর সমন্বয়হীনতা ছিলো চোখে পড়ার মতন।প্রতিটা মহামারি মানবজাতির জন্য একটা বার্তা দিয়ে যায়- সে বার্তাকে অনুধাবন করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার মাঝে ভবিষ্যতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কমিয়ে আনার চেষ্টা করা কার্যকর উন্নয়নের রূপরেখা হওয়া উচিৎ।  

আমিনা রিংকি, সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank