শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ || ৬ বৈশাখ ১৪৩১ || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

প্রাণহীন নির্বাচনে এত প্রাণক্ষয়!

কবির য়াহমদ, সাংবাদিক ও লেখক

১১:৪৭, ৩ ডিসেম্বর ২০২১

৯৭৮

প্রাণহীন নির্বাচনে এত প্রাণক্ষয়!

আওয়ামী লীগ ছাড়া অপরাপর রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে চলা স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিপুল প্রাণহানী হচ্ছে। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত তিন ধাপের নির্বাচনে ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ষাটজন, আহতের সংখ্যা সহস্রাধিক। আচরণবিধি লঙ্ঘন,  জাল ভোট, পেশিশক্তির প্রভাব,  প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগের সব আছে নির্বাচনে, তবু নির্বাচন প্রকৃতই প্রাণহীন।

আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ সত্ত্বেও নির্বাচনে প্রাণ ফেরেনি, আছে শঙ্কা। যার প্রকাশ ঘটেছে ইতোমধ্যে দেশব্যাপী। অথচ স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন ছিল এতদিন উৎসবের, যা এখন রীতিমত আতঙ্কের।  

বিপুল প্রাণহানির এই নির্বাচনও ইসিকে সামান্য নাড়া দিতে পারেনি। বরাবরের মত তারা সাফল্যের দাবি করছে। কষ্টকঠিন বাস্তবতা, অথচ আশ্চর্য নিরব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।  ইসি কেন এমন ভূমিকায়, প্রশ্ন আছে; উত্তর নেই। 

গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে,  প্রথম ধাপের নির্বাচনের দিন ছয়জন, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন সাতজন এবং তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন বিজিবির সদস্যসহ নয়জন প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া নির্বাচনের পূর্বাপর নানা ঘটনায় আরও আটত্রিশজনের প্রাণহানি হয়েছে। ব্যাপক সহিংসতার এই নির্বাচনের শুরু থেকেই নানা সমালোচনা হচ্ছে।  কিন্তু এই সমালোচনা কতখানি গ্রহণ করছে ইসি সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। 

নির্বাচনের আগে-পরে ও ভোটগ্রহণের দিনের সহিংসতা ঠেকাতে গত ১৫ নভেম্বর থেকে সপ্তাহব্যাপী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছিল। সে অভিযানে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্রও উদ্ধার করা হয়, কিন্তু ভোটের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরেনি। যা তৃতীয় ধাপের নির্বাচনেই পরিস্কার। নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, প্রাণহানী হয়েছে, জাল ভোট হয়েছে, নির্বাচন-পূর্ব এবং নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। তবু ইসিও কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে সাফল্যের অযাচিত দাবি। 

তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের আগে মাঠ পর্যায়ে কড়া বার্তা পাঠায় পুলিশ সদর দপ্তর। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, গত রবিবার অনুষ্ঠিত তৃতীয় ধাপে আরও বেশি সহিংসতা ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে। হামলার শিকার হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাও। এই ধাপের নির্বাচনে আগের চেয়ে বেশি তৎপর ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিভিন্ন স্থানে জাল ভোট, ব্যালট ছিনতাই ও আচরণবিধি ভঙ্গসহ নানা অপরাধে শতাধিক লোককে আটক করেছিল তারা। এর মধ্যে অনেককে তাৎক্ষণিকভাবে জেল-জরিমানা করা হয়। তবু কেন ব্যর্থ হলো প্রশাসন, এটা খতিয়ে দেখা দরকার।  

দলীয় প্রতীকের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি দলীয় প্রতীকে অংশ নেয়নি সত্য, তবে দলটির স্থানীয় নেতাদের অনেকেই স্বতন্ত্রভাবে অংশ নিয়েছেন।  বহিস্কারের কড়া হুশিয়ারি সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের অনেকেই দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন। তাদের অনেকেই জয়ীও হয়েছেন।  প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোকে সরকারদলীয় নেতারা স্থানীয় সমস্যা হিসেবে উল্লেখে আগ্রহী হলেও আদতে সহিংসতার বিস্তৃত-রূপ এগুলোকে স্থানীয় সমস্যা ভাবার অবকাশ নাই। সর্বব্যাপ্ত এই সহিংসতা যেন জাতীয় রাজনীতির প্রকাশ্য রূপ;  অস্বীকার করার সুযোগ কোথায়? 

নির্বাচনে টাকার দৌরাত্ম্য ছিল, জাল ভোটের ছড়াছড়ি ছিল, আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ছিল, পেশিশক্তির প্রভাব ছিল। আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিতদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি ছিল, কিন্তু সেই হুশিয়ারি কাজে লাগেনি। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল বলে একের পর এক সহিংস ঘটনা ঘটেছে। বিবাদমান পক্ষগুলো আওয়ামী লীগের হওয়ার কারণেই কি না প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেনি।  অনেক জায়গায় প্রার্থী ও সমর্থকেরা যেভাবে প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন সেগুলোর সবটাই নিশ্চয়ই মিথ্যা নয়। 

নির্বাচনের সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো থাকে ইসির নিয়ন্ত্রণে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে এই নিয়ন্ত্রণ কতটা কার্যকর ব্যবস্থা এটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে। প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে এই পক্ষপাতিত্বের অভিযোগগুলো কখনই আমলে নেওয়া হয় না, বরাবরই অস্বীকার করা হয়; শঙ্কা এবারও তেমন ঘটতে যাচ্ছে। ফলে প্রতিকারহীন এই অভিযোগ। আর এতে সুষ্ঠু  নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন তার সমাধা হচ্ছে না। 

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে দরকার শক্তিশালী ইসি, কিন্তু আমরা সে অবস্থায় নেই। ইসির নিজেদের মধ্যকার বিরোধ প্রকাশ্য। নির্বাচন নিয়ে নানা সময়ে কথা বলা মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে কমিশনের  কারও মতের মিল নেই। ওই কমিশনারের অধিকাংশ বক্তব্যের পালটা বক্তব্য দিতে দেখা যায় অপর কোন নির্বাচন কমিশনারকে, এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকেও (সিইসি)। 

স্থানীয় সরকারের চলমান নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, 'প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন এখন আইসিইউতে থাকার মত অবস্থায়'। এর জবাবে সিইসি বলেছেন, 'মাহবুব তালুকদারের মন্তব্য শালিনতা বহির্ভূত'। ভাবা যায়, খোদ ইসিতেই যখন এমন অবস্থা তখন তাদের শক্তিশালী রূপ থাকে কোথায়? আর শক্তিশালী ইসি না থাকলে নির্বাচন ব্যবস্থা আস্থা না হারালে হারাবে কখন? 

নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ইসির সক্ষমতা ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন নতুন নয়। এবার যোগ হয়েছে বিপুল প্রাণের অপচয়সহ ব্যাপক সহিংসতা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের 'বিদ্রোহী প্রার্থীদের' নির্বাচন হচ্ছে এমনটা উল্লেখে অনেকেই ইসি ও সরকারের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে আগ্রহী। অথচ তাদের এই আগ্রহের বিপরীতে স্বাভাবিক প্রশ্ন- নাগরিকের প্রাণের নিরাপত্তা তবে কে দেবে?  

প্রাণহীন নির্বাচনে এমন প্রাণক্ষয় প্রত্যাশিত নয়। নির্বাচন আয়োজন ইসির জন্যে জরুরি হলেও নাগরিক-নিরাপত্তা জরুরি সবার জন্যেই। ইসিও নিশ্চয়ই সেই 'সবার' বাইরে নয়।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank