শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০ || ১৭ রমজান ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

মেয়েটির বাবার বুধবারে জ্বর আসে!

মোহাম্মদ শাহ আলম

১৫:২১, ২৬ জুন ২০২১

১০০৪

মেয়েটির বাবার বুধবারে জ্বর আসে!

গেল সপ্তাহে আমরা বাবা দিবস উদযাপন করেছি। এই উদযাপনে বাবাদের নিয়ে যারপরনাই নাই গুণকীর্তন করেছি। বাবাদের মাহাত্ম তুলে ধরেছি। বাবারা মাথার ছাতা, বাবারা অকুলের কুল, বাবারা স্বপ্নের কারিগর ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে বাবাদের উচ্চ আসেন বসিয়েছি। বাবাদের বিশালত্ব নিঃসন্দেহে বর্ণনাতীত। বাবাদের নিয়ে আমি নিজেও এই কলামে লিখেছি। পত্রিকারগুলো ফিচার ছেপেছে। ফেসবুক জুড়ে ছিল বাবাদের নিয়ে আবেগঘন পোস্ট।

সত্যিই কি সব বাবারা মহান? এই প্রশ্ন আমাকে চিন্তিত করে। গ্রামের সাথে আমার যোগাযোগ গভীর। আমি এমন অনেক গল্প শুনেছি সেখানে বাবাদের কুৎসিত কদর্য চেহারা বেরিয়ে এসেছে। শহরের অনেক গল্পও আমাকে বিচলিত করেছে। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি বাবাদের নিয়ে নেতিবাচক বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরার জন্য। মাফ করবেন।

অনেক বাবাকে দেখেছি সন্তানদের পুঁজি করে নানা ধরণের অপকর্ম করতে। সন্তান মানুষ করা ঐসব বাবাদের যতটা না ইচ্ছা বা আগ্রহ, তার চাইতে বেশি আগ্রহ সন্তানকে কেন্দ্র করে কীভাবে টাকা পয়সার ধান্ধা করা যায়। এক বাবার ঘরে সুশ্রী সুন্দরী কন্যা। বিয়ের জন্য দেখাদেখি চলে কিন্তু তিনি বিয়ে দেন না। বরপক্ষ দেখতে আসে। পাত্রী দেখে কিছু টাকা পাত্রীর হাতে ধরিয়ে দেন। এটা আমাদের এক সুন্দর সংস্কৃতি। বিষয়টি আর কিছুই না। কন্যাকে সম্মানিত করা। পাত্রী পছন্দ অপছন্দের উপর সম্মানীর টাকা ওঠানামা করে। বাবা খুশি। কিছু টাকা হাতে আসে। যতবার মেয়েকে দেখতে আসে ততবার টাকা। বিয়ে দিয়ে দিলে তো এই রোজগার আর থাকবে না। কী অবিশ্বাস্য চিন্তা পিতার! 

মেয়ে দেখানোর ভেল্কিবাজির মতো ছেলের বিয়ে নিয়ে ঢের গল্প বলা যায়। সবই সত্যি গল্প। ছেলেতো আমাদের সোনার ডিমপাড়া হাঁস! ছেলের বিয়ের আলাপে বাবা চুপচাপ থাকেন। ছেলের খালু মামা চাচারা কথা বলেন। বাবা অপেক্ষা করেন যৌতুকের আলাপটা কখন উঠবে। যৌতুকের পাল্লাটা কত ভারী হবে। যে পাত্রীপক্ষ বেশি যৌতুক দেবে বাবা হয়তো তখন বিয়েতে রাজি হবেন। অথবা আরো বেশি যৌতুকের অপেক্ষায় থাকবেন। আমি তো এক বাবাকে বলতে শুনেছি, পোলা আমার সরকারি চাকরি করে, এত কমে আমি রাজি না। তাঁর দাবি ছিল নগদ কয়েক লাখ টাকা, মোটর সাইকেল, ঘরের সব ফার্নিচার আর ইলেকট্রনিক্স। এমন দুচারটা ছেলে থাকলেতো বাবারা বেঁচে যায়!

অনেক বাবা আছেন যারা ছেলেদের রোজগারে পাঠিয়ে দিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ান। আমি এক বাবাকে চিনি, যিনি ছেলে এসএসসি পাশ করার পর বিদেশে পাঠিয়েছেন। ওদের বিদেশ মানেই তো মধ্যপ্রাচ্য! কী আর বলব, বাবা ছেলেকে দেশে আসতে মানা করেন। দেশে আসলে টাকা খরচ হয়ে যাবে। বছর দশেক পর বাবার মনে হলো ছেলের বিয়ে দেয়া দরকার। ছেলে দেশে এসে বিয়ে করে। নতুন বউ রেখে আবার চলে যাওয়া। কারন বাবা চান না ছেলে দেশে থাকুক। দেশে আসলে রোজগার বন্ধ। এটা আমার দেখা। ঐ বাবার একটাই কাজ, দোকানে বসে আড্ডা দেয়া, বড় বড় কথা বলা আর চা খাওয়া। ছেলের যৌবনের রঙিন সময়টা কাটে অমানুষিক পরিশ্রমে। ঐ ছেলের ফেসবুক থেকে কিছু কথা এখানে তুলে ধরতে চাই।

“না পাই চাকুরী, না পারি ছোট কাজ করতে। পরিবারের সবাই মিলে ঠিক করল বিদেশে পাঠাবে। সংসারের অভাব অনটন। টাকার সংকট। অনেকের হাতে পায়ে ধরে টাকার জোগাড়। অথবা সূদে। অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আসি বিদেশ। বড়লোক হবার আসায়,একটু সুখের আসায়। আসার ২ দিন পর শুরু হয় জীবনের সাথে লড়াই। সকাল ৫ টায় উঠে ডিওটি, রাতে ৮ টায় বাসায়। বাজার করা, হাড়িপাতিল ধোয়া, তরকারী কাটা, রান্নাকরা। খাওয়া দাওয়া করে রাত ১১ টা। আবার সকাল ৫ টায় উঠতে হবে। দুপুরে ১ ঘনটা অবসর। তারাতারী খেয়ে বাড়িতে কথা বলা। এ যেন অন্ত নেই, দিনের পর দিন চলেই যাচ্ছে। ২ বছর রিন পরিশোধ। এতকিছুর ভিতরেও মনে রঈীন সপ্ন। বিয়া করার, অনেক অপেক্ষার পর বাড়িতে যাই ২ মাসের ছুটিতে গিয়ে নিয়া। ২ মাসের ছুটি, এক মাস গেলো বিয়া করতে, হাতে আর ১ মাস। না মেয়ে আমাকে বুজল, না আমি মেয়েকে। আবার ২ বছর পর ছুটি পাবো। ছুটি কেটে আসার পর মনে হয়না বিয়া করেছিলাম কিনা। আর এ ভাবেই চলে বিদেশের জিবন। অনেক সময় বাবা মার কঠিন বক্তব্য। যারা বিদেশ আসেন নাই, তাদের বলছি, ভাল করে লেখা পড়া করুন। দেশেই কিছু করেন। আর মাবাবাদের বলছি সন্তানের জীবনটা এভাবে নষ্ট করবেন না।”

আমি এক বাবাকে চিনতাম। উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। অনেক ভালো জানতাম ওনাকে। একসময় ওনার ব্যাপারে গল্প শুনে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ওনার পরিবারে ছিল স্ত্রী আর এক কন্যা। কন্যা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মা চাকুরী করেন। বাবা মা দুজনেই অফিসে চলে যান। মেয়ে ক্লাস করে বাসায় চলে আসে। সবার কাছেই আলাদা চাবি থাকে। একদিন মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাবাকে বাসায় দেখতে পায়। মেয়েটি এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় যে তাৎক্ষণিক ভাবে সিদ্ধান্ত নেয় বাবাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার। মাকে ঘটনা জানান । সেই থেকে মা আর মায়ে আলাদা থাকেন। এই মেয়ে নিশ্চয়ই বাবাকে নিয়ে বুক ফুলিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় না!

এসব ঘটনা বাবাদের নীচতাকে তুলে ধরে। কিন্তু বাবাদের পিশাচ চেহারাটা ভেসে ওঠে আরো ভয়ানক ও জঘন্য ঘটনায়। পত্রিকায় অনেক সংবাদ আমাদের চোখ এড়িয়ে যায় না। ভয়ানক সব সংবাদ। বিশ্বাস করতে চাই না কিন্তু বিশ্বাস করতে হয়। শুধু এ বছরের কয়েকটা ঘটনা তুলে ধরছি।

ফেব্রুয়ারী ২০২১ সালে একটি পত্রিকা সংবাদ করেছে,
ঢাকার আব্দুল্লাহপুরে নিজের ১৩ বছর বয়সী মেয়েকে ধর্ষণের দায়ে এক রিকশাচালককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

মার্চ ২০২১ একটি পত্রিকার সংবাদ, নিজের মেয়েকে ধর্ষণের দায়ে বাবাকে যাবজ্জীন সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থ দণ্ডাদেশ এবং অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন কক্সবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক।

এপ্রিল ২০২১-এর একটি সংবাদ, নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় এক কিশোরীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তার বাবা ধর্ষণ করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

এবার আসি আজকের শিরোনামে, “মেয়েটির বাবার প্রতি বুধবারে জ্বর আসে”। একটি কল্পিত শিরোনাম কিন্তু ঘটনা সত্য এবং ভয়ংকর। মাত্র আট বছর বয়সী একটা মেয়ে। মা গার্মেন্টসে যায়, বাবা যায় কাজে। মা সারাদিন খাটুনির পর বাসায় আসে। মেয়েটার যত্ন করে। বাবাও সন্ধায় কাজ থেকে ফিরেন। গেল বুধবার মেয়েটির মা একটু আগেই বাসায় চলে আসেন। দুপুর দেড়টার দিকে মা বাসায় ফিরে ঘরের ভেতরে মেয়েকে শুয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর দেয়নি মেয়ে। পরে তার গায়ের কাঁথা সরিয়ে তাকে বিবস্ত্র এবং রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান। মা কাজে থাকার সময় দুপুরের আগে কোনো এক সময় মেয়েটির বাবা ধর্ষণ করে বাইরে চলে যান বলে একটি মামলায় অভিযোগ করেন মা। ঘটনার পর থেকে মেয়েটির বাবা পলাতক রয়েছেন। মেয়েটির মা এই ঘটনার সাথে সংযোগ করার চেষ্টা করেন, কেন প্রায় বুধবারের মেয়ের বাবা অসুস্থ হয়ে পরেন। কাজে যান না।

আমি শিশুদের নিয়ে কাজ করি। শিশুদের নিরপত্তার বিষয়টি আমাকে চিন্তিত করে। অবস্থাটা সত্যি ভয়ানক আমাদের সমাজে। কাকে বিশ্বাস করবেন আপনি। বাবা, চাচা, মামা? গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রতি চার জন মেয়ে শিশুর মধ্যে একজন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়৷ আর প্রতি ছয় জন ছেলে শিশুর মধ্যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় একজন৷ যে সকল শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তার ৭৫ ভাগ শিশুর যৌন নিপীড়ক পরিবারের ঘনিষ্ঠজন। মায়েদের বলছি, সাবধান থাকুন। সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে থাকেন।

আর হ্যাঁ, শেষমেষ আরেকবার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি বাবাদের নিয়ে নেতিবাচক বিষয় তুলে ধরার জন্য।বেশিরভাগ বাবারাই ভালো। আমরা সব বাবাদের নিয়ে গর্ব করতে চাই।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank