শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৫ চৈত্র ১৪৩০ || ১৭ রমজান ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

তালপাতার হাতপাখায় জীবনগাঁথা...পুঁজি সঙ্কটই বড় বাধা

ছবি ও ফিচার: কমল দাশ

০১:০৪, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আপডেট: ০১:১৪, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

৩৯৫৬

তালপাতার হাতপাখায় জীবনগাঁথা...পুঁজি সঙ্কটই বড় বাধা

তালপাতার হাতপাখা তৈরির ধুম পড়েছে চন্দনাইশের তিন গ্রামের প্রায় সব ঘরে। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অংশে হাতপাখার চাহিদার সিংহভাগ জোগান দেয় এই চন্দনাইশ। এখানকার হাতপাখার আলাদা কদর রয়েছে দেশজুড়ে। গরম পড়তে শুরু করেছে। তা যত বাড়ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চন্দনাইশের পাখাশিল্পীরাও পার করছেন মহাব্যস্ত সময়।

সরেজমিন দেখা যায়, চন্দনাইশ পৌরসভার ছয় নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ জোয়ারা জিহস ফকিরপাড়া, দক্ষিণ গাছবাড়িয়ার কমল সওদাগরপাড়া ও সাতবাড়িয়ার কদমতলীপাড়ার নারীরা ভীষণ ব্যস্ত। সকাল থেকে ঘরের অঙিনায় বসে সবাই তৈরি করছেন হাতপাখা। কেউ তালপাতা চিরিয়ে নিচ্ছেন, কেউ হাতপাখা তৈরি করছেন, আবার কেউ তৈরি করা হাতপাখায় বেত দিয়ে চাকা বাঁধছেন। আবার কেউ তালপাতায় রং দিচ্ছেন। একেকজন একেক কাজে ব্যস্ত। কিছু কিছু পরিবারের পুরুষরা তাঁদের কাজে সহযোগিতা করছেন।

তাদের সঙ্গে কথা বলেই জানা গেলো এর তৈরি প্রক্রিয়া। জানালেন, একটি হাতপাখা তৈরি হতে আটজনের হাতের ছোঁয়া লাগে। এর মধ্যে একেকজনের কাজ একেকটি। পাখা তৈরির মূল উপকরণ তালপাতা, বেত, বাঁশ ও রং। এখানে বিভিন্ন মানের পাখা তৈরি হয়। মান ভেদে একটি হাতপাখা ১০০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে বেশির ভাগ পাখাশিল্পী পুঁজির অভাবে কাঁচামাল কিনতে পারেন না। ফলে তাঁরা দর নির্ধারণ করে চুক্তিতে হাতপাখা তৈরি করেন। কিছু পরিবার নিজেরা কাঁচামাল কিনে পাখা তৈরি করেন এবং সরাসরি পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন।

‘হাতপাখা তৈরি ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প। তবে এখানকার বেশির ভাগ পাখাশিল্পী পুঁজি সংকটে রয়েছেন। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদানসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ উচিত বলে মনে করেন সাধারণ এলাকাবাসি  রয়েছে।’

দক্ষিণ জোয়ারা জিহস ফকিরপাড়ার পাখাশিল্পী আবুল কালাম জানান, চন্দনাইশের তিন গ্রামের প্রায় ৯০ ভাগ পরিবার হাতপাখা তৈরির সাথে জড়িত। এই তিন গ্রামের হাজারের অধিক নারী পাখা তৈরি করেন। ঘরের বউ-শাশুড়ির পাশাপাশি স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েরাও অবসর সময়ে হাতপাখা তৈরি করে। তারাও খুব নিখুঁতভাবে হাতপাখা তৈরি করতে পারে। এখানকার কারুকার্যমণ্ডিত হাতপাখা সারা দেশে জনপ্রিয়। চন্দনাইশের তালপাতার তৈরি হাতপাখার কদর আলাদা।

আবুল কালাম বলেন, ‘এখানকার প্রায় পরিবার হাতপাখা তৈরির সাথে জড়িত থাকলেও পুঁজির অভাবে লাভবান হতে পারেন না। বেশির ভাগ পরিবার পুঁজির অভাবে চুক্তিভিত্তিক অন্যের কাজ করে দেন। অনেকে স্থানীয় পাইকারদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে হাতপাখা তৈরি করেন। ফলে পূর্ব নির্ধারিত মূল্যে বছরের শুরুতে পাখা বুঝিয়ে দিতে হয়।’

তিনি জানান, হাতপাখা তৈরির কাজে নারীরা সম্পৃক্ত থাকার কারণে এই কুটির শিল্প এতদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। পুরুষরা উপকরণগুলো সংগ্রহ করে দেওয়ার পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু কাজ করেন। অন্য কাজগুলো নারীরা করে থাকেন। তালপাতাসহ উপকরণ সংগ্রহের পর এগুলো শুকাতে দেওয়া, রং করা, পাতা ও বেত চিরিয়ে নেওয়া, পাখার মূল বডি প্রস্তুত করাসহ বেশির ভাগ কাজ নারীরা করেন। বিশেষ করে পাখার চার পাশে বেতের চাকা বাঁধা এবং হাতল লাগানোর কাজগুলো পুরুষদের করতে হয়। তালপাতা, বেত ও বাঁশসহ হাতপাখা তৈরির মূল উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচ একটু বেশি হয়। সরকার ঋণের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।

একই এলাকার রাজা মিয়ার স্ত্রী ইসলাম খাতুন বলেন, ‘হাতপাখার সাথে আমাদের জীবন জীবিকা জড়িত। টাকার অভাবে পাখা তৈরির কাঁচামাল কিনতে পারি না। ফলে স্থানীয় পাইকারদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে হাতপাখা তৈরি করি। প্রায় সারা বছরই চলে পাখা তৈরির কাজ।’

‘আমার স্বামী গাড়ি চালান। ২ ছেলে ১ মেয়েসহ পাঁচজনের সংসার। স্বামীর রোজগারের পাশাপাশি হাতপাখা তৈরি করে আমিও কিছু টাকা আয় করি।’

এখানে বিভিন্ন মানের হাতপাখা তৈরি হয়। প্রতি জোড়া পাখা ২০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে মধ্যম মানের পাখা বেশি বিক্রি হয়। সারা বছর পাখা তৈরি হলেও কোরবানির ঈদের পর থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত পাখা বেশি তৈরি হয়। চট্টগ্রামের লালদিঘির পাড়ে জব্বারের বলীখেলাসহ বিভিন্ন মেলায় সবচেয়ে বেশি হাতপাখা বিক্রি হয়।

কুমিল্লা, নোয়াখালী এলাকা থেকে তালপাতা আনতে হয়। পাখা তৈরির আয় দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবু বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী পেশা হিসেবে হাতপাখা তৈরিকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন তারা।

সরকার উদ্যোগ নিয়ে পাখাশিল্পীদের স্বল্প সুদে এবং সহজ শর্তে ঋণ না দিলে পুঁজি সংকটের কারণে এই কুটির শিল্পকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত