বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

মসলিন ফিরছে বাংলাদেশে!

বিশেষ সংবাদদাতা

১০:০৭, ১২ জানুয়ারি ২০২১

আপডেট: ১৮:৩৪, ১৪ জানুয়ারি ২০২১

১৪০৭

মসলিন ফিরছে বাংলাদেশে!

তুলোর সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম সুতোর বুননে পাতলা, মোলায়েম এক কাপড়ের নাম মসলিন। যা একসময় ঢাকার তাঁতীরা বুনতে পারতেন। বিশ্বের আর কেউ কোথাও এত সুক্ষ্ম, সুন্দর কাপড় বয়ন করতে পারেনি। ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে চীনা পরিব্রাজন হিউয়েন শাং তার ভারত ভ্রমণে এসে যে মসলিনের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ভোরের সূর্যালোকে সৃষ্ট জলীয়বাষ্পের মতো মোলায়েম এক কাপড়। বাষ্পের মতোই ছিলো এই কাপড়ের ঘনত্ব। ফলে মিহিন পাতলা কাপড় ছিলো কাচের মতোই স্বচ্ছ। 

সেই ঢাকাই মসলিন আবার ফিরে আসছে। আর গবেষকরা এতটাই দূর এগিয়েছেন যে বলা হচ্ছে, আগামী দুই বছরে বাংলাদেশের কারিগররা মসলিন কাপড় বানাতে পারবেন।      

নতুন করে কিভাবে বানানো হবে? বিষ্ময়ের সে জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়ার আগে পাঠককে ধারনা দিয়ে রাখা যায় অতীতে কিভাবে বানানো হতো।  ফুটি কার্পাস নামে এক বিশেষ ধরনের তুলায় তৈরি হতো অতি চিকন সুতার এই মসলিন। উইকিপিডিয়া লিখছে, চড়কা দিয়ে কাটা, হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হত যার ফলে মসলিন হত কাচের মত স্বচ্ছ। এই মসলিন রাজকীয় পোশাক নির্মাণে ব্যবহার করা হত। মসলিন প্রায় ২৮ রকম হত যার মধ্যে জামদানী এখনও ব্যাপক আকারে প্রচলিত। নানা কারণে আঠারো শতকের শেষার্ধে বাংলায় মসলিন বয়ন বন্ধ হয়ে যায়। 

কিভাবে বন্ধ হয়েছে সে বর্ণনায় বিভিন্ন গল্প প্রচলিত রয়েছে। তবে পাঠককে জানানো যেতে পারে কিভাবে ফিরছে!

সেটি ২০১৪ সাল। ঢাকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দৃক পিকচার লাইব্রেরি এই মসলিনের উপর ব্যাপক গবেষণা শুরু করে। প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহীদুল হকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটি তাঁতি, জাদুঘরের অধিকর্তা আর কাপড় বুননের কারিগরদের নিয়ে একটি দল গঠন করে। আর গবেষকরা তো রয়েছেনই। 

সেবছর অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মসলিন কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করার নির্দেশ দেন। সে বছরই সরকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় এবং গবেষকদের সমন্বয়ে একটি দল গঠন করে কাজ শুরু করে। 

বস্তুত বইয়ের পাতা, আর জাদুঘরের প্রদর্শনীর বাইরে এই মসলিনের অস্তিত্ব ছিলো না। গবেষকদের প্রচেষ্টায় সংগৃহীত হয় তথ্য-উপাত্ত, ঘটনা-অঘটন। তারই সন্নিবেশে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে 'মসলিন: আমাদের গল্প' নামে একটি বই প্রকাশ করে দৃক। সে বছরই প্রথম মসলিন উৎসব আয়োজন করা হয়। যাতে উপস্থাপিত হয় মসলিনের ইতিহাস। কর্মশালাগুলোতে বর্ণনা করা হয় মসলিন তৈরির নানা দিক। চলচ্চিত্রে ধারণ করা মসলিনের নানা নিদর্শনও তাতে তুলে ধরা হয়। তখন থেকেই এই ঐতিহ্যবাহী পোশাকটি ফের তৈরির উৎসাহ জাগ্রত হয়। 

সেই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে গবেষকরা যখন এগুচ্ছিলেন তাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিলো, মসলিনের সঠিক একটি নমুনা হাতে পাওয়া। আর দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি ছিলো সঠিক সুতোটি নির্দিষ্ট করে নেওয়া। সরকারি প্রকল্প দলটি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশের জাদুঘর ও ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তাতে তাদের হাতে যে নমুনাগুলো আসে তার কোনোটিই প্রকৃত মসলিন ছিলো না। ২০১৭ সালে চার সদস্যের একটি দল লন্ডন সফর করে এবং ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট জাদুঘর থেকে ১৭১০ সালে তৈরি একটি মসলিন থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আনে। 

এদিকে বাংলাদেশ তাঁত শিল্প বোর্ডের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে সাত-সদস্যের একটি দল কাজ শুরু করে সেই সুতোর খোঁজে, যে সুতোয় এক সময় তেরি হতো এই মসলিন। সুইডিশ বোটানিস্ট কারোলাস লিনাইয়াস তার ১৭৫৩ সালে রচিত স্পেসিস প্ল্যান্টারাম নামের বইয়ে মসলিন তৈরির উপকরণ হিসেবে ফুটি কার্পাস নামে এক জাতের তুলোর কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেই তথ্য গুরুত্বে দিয়ে গবেষকরা ফুটি কার্পাসের খোঁজে নামেন।

এবার গবেষকরা ফুটি কার্পাস তুলোর একটি গাছের ছবি ব্যবহার করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। যদি কেউ কোথাও এমন তুলোর গাছের সন্ধান পান তাদের যোগাযোগ করতে বলেন।  এছাড়া তারা নিজেরাই দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে কার্পাস তুলোর নমুনা সংগ্রহ করতে থাকেন। কোনো তুলোর সঙ্গে ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট জাদুঘর থেকে আনা মসলিনের নমুনার সঙ্গে তুলোর জেনরিকের মিল খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগের নিজস্ব বাগানে পাওয়া একটি তুলো গাছের তুলোর সঙ্গে অনেকটা কাছাকাছি মিল খুঁজে পান গবেষকরা।

এবার গবেষক দল দুই জন তাঁতীকে খুঁজে বের করেন, যাদের ঐতিহ্যবাহী তাঁত বয়নের দক্ষতা ও জ্ঞান রয়েছে। ১৭১০ সালে বোনা মসলিন শাড়ির সঙ্গে সাদৃশ্যময় শাড়ি তারা বয়ন করলেন। এর ছটি নমুনা তারা তৈরি করলেন।  যা নতুন করে পথ দেখাচ্ছে দেশে মসলিনের বয়ন ফিরিয়ে আনার। 

বাংলাদেশ সরকার  মসলিন উৎপাদনের জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন (জিআই) এর জন্য আবেদন করে। এর মধ্য দিয়ে এই বিশেষ পণ্য উৎপাদনের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিচয় থাকবে বাংলাদেশের। যা এরই মধ্যে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের চতুর্থ জিআই পণ্য হিসেবে বিশ্বের কাছে স্বীকৃত এই মসলিন।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত