শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৫ চৈত্র ১৪৩০ || ১৭ রমজান ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

তিস্তা ঘিরে মহাপরিকল্পনা, বদলে দেবে জীবন, অর্থনীতি

বিশেষ সংবাদদাতা

২৩:৫৩, ৫ ডিসেম্বর ২০২০

১১৭৮

তিস্তা ঘিরে মহাপরিকল্পনা, বদলে দেবে জীবন, অর্থনীতি

তিস্তা নদী, ছবি: সংগৃহীত
তিস্তা নদী, ছবি: সংগৃহীত

তিস্তা নদী ঘিরে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী চীন। এলক্ষ্যে 'তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন' প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রকৌশলগত ও আর্থিক সহায়তা দেবে ইয়োলো রিভার ইঞ্জিনিয়ারিং চায়না। সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীনও। পদ্মাসেতুর পরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বড় প্রকল্প হতে চলেছে তিস্তাকে ঘিরে উন্নয়ন।

এর মধ্য দিয়ে সরকার ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা করতে সক্ষম হবে। এবং প্রতিবছর ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারবে।

যেসব সুবিধা হবে
প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলার মানুষের ভাগ্যের চাকা এমনটাই ভাবছেন পরিকল্পনাবিদরা। ভারত যুগের পর যুগ তিস্তা চুক্তির মুলা ঝুলিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের সামনে। সে কারণে চীনের তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারত থেকে বাংলাদেশের অতিরিক্ত পানির আর প্রয়োজন পড়বেনা।

তিস্তার পারে শতশত একর ভূমি পুনরুদ্ধার হবে। ভূমিহীন মানুষের আশ্রয় স্থল কিংবা শিল্পায়নের কাজে যা লাগানো যাবে। চীনের হোয়াংহো নদী ও সুকিয়ানসিটির  আদলে তিস্তার দু’পারে আধুনিক শহর গড়ে উঠবে। বাঁধের দু’পাশে থাকবে সমুদ্র সৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ। দু’দিকের রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহন করা যাবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট গড়ে তুলতে আগ্রহী হবেন।

থাকবে নদী শাসন, ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা। নদীর গভীরতা প্রায় ১০মিটার বৃদ্ধি পাবে। বন্যার পানি উচলে ভাসবেনা গ্রাম-গঞ্জ-জনপদ। সারাবছর নৌ-চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণ থাকবে। নৌবন্দরও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় দু’পারে থানা, কোস্টগার্ড, সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাস্প থাকবে।

এখানে দেড়শ' মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন হবে। আধুনিক সেচ প্রকল্প ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ কৃষি খামার তৈরি হবে। মৎস্য চাষ বাড়বে। তিস্তা হবে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।৭-১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে এই প্রকল্পে।

মহাপরিকল্পনার অগ্রগতি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সকল অগ্রাধিকার দিয়েছেন।  এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশন থেকে সেটি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে- ইআরডিতে পৌঁছেছে। চায়না পাওয়ার কোম্পানি দুই বছর ধরে তিস্তা পারে নির্মিতব্য প্রকল্প বাস্তবায়নে নকশা এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করেছে। নদী পারের জেলাগুলোয়-নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধায় চীনের তিনটি প্রতিনিধি দল কাজ করছে। শিগগির এনিয়ে দেশটির সঙ্গে চুক্তি হবে। এরপর দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু হবে।

উদ্ধৃতি
কিছুদিন আগে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলেই ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হবে। তবুও একে ঘিরে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দাতাদেশ গুলোর সামনে তিস্তা প্রকল্প উত্থাপন করা হয়েছে। এবিষয়ে চীন প্রবল আগ্রহ দেখিয়েছে। সমীক্ষা শেষে প্রকল্পটি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) রয়েছে। দেশটি ইআরডির সঙ্গে যোগাযোগ করছে।

প্রকল্প নিয়ে যখন স্বপ্ন দেখা শুরু
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে চীন সরকারের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সফরে দেশটিতে যান। সেসময় চীনের সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্প ও বাণিজ্য বিষয়ে বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় এবং স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওই সময় তিনি প্রস্তাব করেন, এক সময় চীনের দুঃখ খ্যাত হোয়াংহো নদী নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির আশীর্বাদে পরিণত করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের তিস্তাকে সেই রূপ দেয়া যায় কিনা। পরে চীন সরকার নিজ উদ্যোগে ও খরচে দুই বছর ধরে তিস্তা নদীর ওপর সমীক্ষা চালায়। তা শেষে একটি প্রকল্প নির্মাণের প্রস্তাব দেয়।

যে কারণে এ উদ্যোগ
প্রস্তাবিত এ প্রকল্পের ৬৫ কিলোমিটার উজানে কালীগঞ্জের গজলডোবায় সেচ প্রকল্প তৈরি করেছে ভারত। এর মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করছে তারা। এতে তিস্তার বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রতি বছর বন্যা ও খরা দেখা দেয়। নদীর পানি বণ্টন চুক্তি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে প্রতিবেশি দেশটি। ফলে এদেশের লাখ লাখ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তাদের বাঁচাতে বর্তমান সরকার নতুন এ প্রকল্প নেয়। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের আর্থিক সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ নেবে। পাল্টে যাবে এসব এলাকার মানুষের জনজীবন। তিস্তা পারের মানুষের দুঃখের দিন শেষ হবে।

ভূ-রাজনীতি
তিস্তা প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগে খুশি নয় ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশকে নিজের বলয়ে রাখতে চায় দেশটি। গুঞ্জন, এদেশের উন্নয়নে চীনা বিনিয়োগে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। অথচ প্রতিবেশি হওয়া সত্ত্বেও এপার বাংলায় তাদের বিনিয়োগ যৎসামান্য।

লাদাখ সীমান্তে চীনের কাছে নাস্তানাবুদ ভারত। তারা চায় বাংলাদেশ যেন চীন থেকে দূরে থাকে। এজন্য দেশটি মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার পুরনো রেকর্ড বাজাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ বিনিয়োগ করেনি। বর্ষপঞ্জিকার পাতা উল্টালে দেখা যায়, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ২৮৭ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। এতে চীনের অবস্থান প্রথম, সেখানে ভারতের স্থান নবম।

বিরোধিতায় অপ্রচার
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে একটি চক্র নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা বলছে, চীনের অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হবে। তবে সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার। তারা জানিয়েছে, এটি বাংলাদেশের একটি উন্নয়ন প্রকল্প। বিশ্বের সবদেশকে এখানে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়া হয়। সেখানে চীন এগিয়ে এসেছে।

বঙ্গবন্ধুরও স্বপ্ন ছিল
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে কাকিনায় তিস্তা নদীতে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন।  ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট তাকে হত্যার পর সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে খরস্রোতা তিস্তা আশীর্বাদ থেকে অভিশাপে পরিণত হয়।

বরাবরই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে সচেষ্ট তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ধারাবাহিকতায় তিস্তা প্রকল্প হাতে নিয়েছেন তিনি। এটি বাস্তবায়ন হলে তিস্তা নদী হয়ে উঠবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় সম্পদ। ফিরে আসবে জীববৈচিত্র্য। মরুপ্রক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে লাখ লাখ মানুষ।
 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত