শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০ || ১৭ রমজান ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

মেহেরুল হত্যার আসামি কে বা কারা? এটা কি কোন পারফেক্ট ক্রাইম?

ইয়াহিয়া খান রুবেল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে

২০:২৬, ৩১ মে ২০২১

আপডেট: ২০:২৭, ৩১ মে ২০২১

৪৪৪৫

মেহেরুল হত্যার আসামি কে বা কারা? এটা কি কোন পারফেক্ট ক্রাইম?

যেভাবে পাওয়া যায় মেহেরুলের লাশ
যেভাবে পাওয়া যায় মেহেরুলের লাশ

প্রতিবন্ধী মা আনোয়ারীর (৫৫) একমাত্র সন্তান ছিলেন মেহেরুল ইসলাম (৩২)। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার রাজারামপুর এলাকার বাসিন্দা বিধবা আনোয়ারী তার সেই ছেলেটিকেও হারিয়েছেন। ছেলের ছবি বুকে ধরে এখন তার দিন যায়। এদিকে সিআইডি'র কাছে থাকা মেহেরুল হত্যার কোনো কুল-কিনারা পাঁচমাসেও বের করা সম্ভব হয়নি। এলাকাবাসীর প্রশ্ন- ছেলেটি একটি লাল হেলমেটধারীর মোটরবাইকে চড়ে সেই যে গেলো এরপর তো তার ক্ষত-বিক্ষত লাশই মিললো। কেউ জানতে পারলো না- কে ছিলো সেই মোটরবাইকে?

মেহেরুল ছিলেন পেয়ারাবাগানের শ্রমিক। গেল বছরের ২১ ডিসেম্বর বেগমনগরের দিয়ারাপাড়ার আমবাগানে মেহেরুলের ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। সেদিনই তার মামা এনারুল ইসলাম গোমস্তাপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। আসামি অজ্ঞাত। হত্যাকাণ্ডের পর পাঁচ মাস পার হয়ে গেলেও এখনো কে প্রকৃত আসামি তা জানা সম্ভব হয়নি। উদঘাটন হয়নি হত্যার রহস্য। 

দিন এনে দিন খাওয়া পরিবারের প্রতিবন্ধী মায়ের একমাত্র পিতৃহারা সন্তান মেহেরুলকে কি কারণে আর কারাই বা হত্যা করতে পারে? এ নিয়ে গোমস্তাপুর উপজেলার এলাকাবাসীর মধ্যে উদ্বেগ, আগ্রহ ও ব্যাপক চাঞ্চল্য রয়েছে। আর দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে কোন আসামির সন্ধান না মেলায় তারা অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন- এটা কি কোন পারফেক্ট ক্রাইম?

পরিবার জানায়, গোমস্তাপুরের পেয়ারাবাগানে মেহেরুলের কাজের মেয়াদ শেষ হলে বাগানের মালিকের সঙ্গে হিসেব-নিকেষ চুকিয়ে মা ও খালার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে আসেন মেহেরুল। দিনটা ছিলো ২০ ডিসেম্বর। মায়ের সঙ্গে দেখা করে সেদিনই খালার বাড়িতেও যান মেহেরুল। সেখান থেকে সন্ধ্যায় বের হয়ে আসেন। এরপর আর ফেরেননি।  

পরের দিন অর্থাৎ ২১ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে বেগমনগর দিয়ারাপাড়ার আমবাগানের মধ্যে মেহেরুলের লাশ পড়ে থাকতে দেখে গ্রামবাসী। গোমস্তাপুর থানায় খবর দেওয়া হলে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা মেহেরুলের লাশের দুটি চোখ ছিল ক্ষত-বিক্ষত, অণ্ডকোষ ধারালো অস্ত্র দিয়ে চিরে দেয়া হয়েছিলো। মেহেরুলের পকেট থেকে দড়ি, ব্লেড ও বিড়ির প্যাকেট উদ্ধার করে পুলিশ। সুরতহালের বর্ণনায় এমনটাই রয়েছে। 
  
মেহেরুলের মামা এনারুল ইসলাম ওই দিনই গোমস্তাপুর থানায় অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন। পরে গোমস্তাপুর থানা পুলিশ থেকে মামলাটি সুরাহা করার দায়িত্ব পায় ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। ময়না তদন্তের রিপোর্টে বলা হয়, গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে মেহেরুলকে। এ বিষয়টিকে সামনে রেখে সিআইডি তদন্ত কাজ শুরু করে। সিআইডি মামলাটি হাতে পেয়ে সক্রিয় হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোন ফলাফল দেখাতে পারেনি। ঘটনার পাঁচ মাস পরেও জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধানেই সীমিত রয়েছে মামলার কার্যক্রম।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় ফরেনসিক রিপোর্ট ঘটনার পাঁচ মাস পরেও তাদের হাতে আসেনি, এ কারণে মামলা তদন্তে সমস্যা হচ্ছে বলেই জানান সংশ্লিষ্ট একাধিক সিআইডি কর্মকর্তা। 

এ প্রসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সিআইডি পুলিশ-এর পরিদর্শক মিজানুর রহমান বলেন, এখনো তদন্ত চলছে। 

তবে তার কথায় অভিযোগের সুর। তিনি বলেন, মামলার বাদী কোন রকম সাহায্য করছেন না। বলেন, এটা একটা বড় সমস্যা। ধারণার উপর ভিত্তি করে কোন কিছু করা যায়না। তবে এখনো সিআইডি আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

এদিকে, মামলার বাদী মেহেরুলের মামা সিআইডির এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে বলেন, তথ্য দিচ্ছেন না সিআইডির এমন অভিযোগ সঠিক নয়। বলেন, তারা কোন চাপের মধ্যে নেই। ঘটনার কিছু বুঝতে পারছেন না বলেই তারা তেমন কোন তথ্য দিতে পারছেন না।  

এদিকে সিআইডি'র তদন্ত না এগুলেও মেহেরুলের আত্মীয়-স্বজন আর এলাকাবাসীর মুখে মুখে চলছে নানা গল্প। তারা নিজেরা নিজেদের মতো নানা সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত।    

মামলাটির বাদী এনারুলের স্ত্রী নাজমা খাতুন পলির ধারনা, মেহেরুল হত্যাকাণ্ডের একটা বড় কারণ পাওনা টাকা হতে পারে। অপরাজেয়বাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, মেহেরুল তার এক বন্ধুকে ৭০ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে সেই টাকা পরিশোধ না করলে মেহেরুল তার কাছে টাকা চাইতেন। পাওনা টাকা চাওয়ার জন্য বন্ধুটি মেহেরুলকে অনেক সময় মারতে চাইতো বলেও অভিযোগ নাজমা খাতুন পলির।

নাজমা খাতুন মেহেরুলের এই বন্ধুটির নাম উল্লেখ করলেও সে বিষয়ে কোনো নিশ্চিত তথ্য না থাকায় এই প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হলো না। তবে অপরাজেয়বাংলার কথা হয় অভিযুক্ত বন্ধুটির সঙ্গে। তার দাবি ৭০ হাজার নয় মেহেরুল তার কাছে ৩৫ হাজার টাকা পেতেন। আর মেহেরুলের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। তিনি হত্যাকাণ্ডের দিন বাড়িতেই ছিলেন। এসবে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন তিনি। 

অনুসন্ধানে জানা যায় হত্যাকাণ্ডের আগের দিন ২০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গোমস্তাপুর দাঁড়াবাজ মোড়ের আজিজুলের মুদীর দোকানে গিয়েছিলেন মেহেরুল। সেখানে তিনি আজিজুলকে তার পাওনা ২৯৫ টাকা পরিশোধ করে দোকান থেকে বের হয়ে যান। সেখানে এখলাস নামে এক প্রতিবেশি মেহেরুলকে কোথায় যাচ্ছেন তা জানতে চান। মেহেরুলের জবাব ছিলো, গোমস্তাপুর হয়ে একটা পিকনিকে অংশ নেবেন। এরপরপরই একটি মোটরবাইকের পেছনে চেপে বসতে দেখা যায় তাকে। তবে এটি কার মোটরসাইকেল ছিল তা ওই দোকানে যারা ছিলেন তাদের কারো জানা ছিলো না বলেই সকলের দাবি। তারা শুধু এটুকুই জানাতে পারেন, চালকের মাথায় লাল রঙের হেলমেট ছিলো, পরনে রেনকোট, গলায় মাফলার প্যাঁচানো। এসব কারণে মোটরসাইকেল চালককে তারা চিনতে পারেননি।

মেহেরুল গোমস্তাপুরের যে পিকনিকে অংশ নেবার কথা বলেছিলেন সেই পিকনিকে অংশ নেওয়া একাধিক জনের দাবি, পিকনিক ছিল ঐ ইউনিয়নের চৌকিদার স্টাফদের। তাই পিকনিকে মেহেরুলের অংশ নেওয়ার কোন সুযোগ ছিলনা। তারপরেও পিকনিকে অংশ নেবার কথা কেন বলেছিলেন তা তাদের জানা নেই। আর ওই পিকনিকে মেহেরুল যাননি বলেও তারা নিশ্চিত করেন। 

তবে অপর একটি তথ্য বলছে, সেরাতে একই এলাকার নূহ মার্কেটে আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আলমাসের চায়ের দোকানে যান মেহেরুল। সেসময় কোনো মোটরসাইকেল চালককে তার সাথে দেখা যায়নি। চা দোকানদার আলমাস জানান,  তার দোকানে রাত প্রায় সাড়ে নয়টা পর্যন্ত একা একটা বেঞ্চে বসেছিলেন মেহেরুল। সে সময় তাকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল বলে জানান চা দোকানদার। এরপর মেহেরুল চলে যান।

মেহেরুলের একাধিক প্রতিবেশির দাবি, হত্যাকাণ্ডের আগের দিন সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত মেহেরুলের গতিবিধি সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে হত্যারহস্যের কূল-কিনারা উদঘাটন করা সম্ভব হতো। তাদের মনে অন্য চিন্তাও আসে। যা কেউ কেউ মুখেও বলছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেহেরুলের কয়েকজন প্রতিবেশী বললেন, মেহেরুল একসময় পাশের গ্রামের এক ব্যক্তির বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা করতেন। সেই সময় একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেই সম্পর্কটা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। প্রতিবেশিদের মতে, এই বিষয়টিও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসা দরকার। 

এছাড়া মেহেরুল হত্যাকাণ্ডের পর ঐ এলাকায় একটি ঔষুধের দোকান কয়েক মাস বন্ধ থাকার বিষয়টিও সন্দেহের চোখে দেখছেন এলাকাবাসীর কেউ কেউ।

গোমস্তাপুরবাসী মনে করছে মেহেরুল হত্যাকাণ্ডে তদন্তে ঘাটতি রয়েছে। তাদের মতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মনযোগ দিয়ে কাজ করলেই দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে মেহেরুল হত্যাকণ্ডের যে রহস্য উন্মোচিত হয়নি, তা অবশ্যই উন্মোচিত হবে।
 
সিআইডি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, তারা বেশ কিছু ঘটনাকে সামনে রেখে তদন্ত করছেন। তদন্তের স্বার্থে সবকিছু এখনি বলা যাবেনা। তবে হত্যাকারী যে বা যারাই হোক তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে বলে দৃঢ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন সিআইডির এই কর্মকর্তা।

মেহেরুলের প্রতিবন্ধী মা আনোয়ারী এখনো একমাত্র সন্তান মেহেরুলের ছবি বুকে নিয়ে অশ্রুঝরা চোখে তাকিয়ে থাকেন। তার এই প্রতীক্ষা কবে শেষ হবে?

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত