মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ || ১০ বৈশাখ ১৪৩১ || ১২ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সোশ্যাল মোবাইল জার্নালিজম ম্যানুয়াল: ফণিভূষণের নতুন গল্প

রাজীব নন্দী, শিক্ষক ও গবেষক

০৯:৪৫, ৩১ জুলাই ২০২১

১৪২৭

সোশ্যাল মোবাইল জার্নালিজম ম্যানুয়াল: ফণিভূষণের নতুন গল্প

কথাচ্ছলে রসিকতা করা আমার (বদ)অভ্যাস। তবে রস যাতে গড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য পাঠক-দর্শক-শ্রোতা-শিক্ষার্থীরা আমাকে ঘিরে থাকে, সতর্ক রাখে। রসিকতা করতে করতে এই লেখার শিরোনাম দিলাম ‘ফণিভূষণের নতুন গল্প’। কে এই ফণিভূষণ? কেন তিনি ‘নতুন গল্প’ লিখতে (পড়ুন- বলতে) বসলেন? রবীন্দ্রনাথের ‘মণিহারা’ গল্পের ফণিভূষণ কি? 

উত্তর- ‘হ্যাঁ’। রবিঠাকুরের ‘মণিহারা’ গল্পটি বহুল পঠিত। দারুণ ছোটগল্পটি নিয়ে সত্যজিৎ রায় বানিয়েছেন ‘তিন কন্যা’ চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মণিহারা’। বাংলা সিনেমাপ্রেমীদের কাছে এই সিনেমা বহুবার প্রদর্শিত। ‘মণিহারা’ গল্পটির শুরু থেকে শেষ অবধি উত্তম পুরুষে আমরা যার মুখে গল্পটি শুনি সে আর কেউ নয়, খোদ ‘ফণিভূষণের ভূত’!

মণিহারা’র ফণিভূষণ যেমন দারুণ গল্প বলিয়ে, তেমনি হাল আমলে সাংবাদিকরাও গল্প বলছেন মোবাইল ফোনে। আমি কায়দা করে ফোনে গল্প বলার ধরণ (মোজো স্টোরি টেলিং)-কে নাম দিয়েছি ফণিভূষণ। কারণ, মোবাইল ‘ফোন’কে ‘ভূষণ’ অর্থাৎ অলঙ্কার হিসেবে হাতে রেখে যিনি গল্প বলতে জানেন তিনিই এই যুগের ফণিভূষণ।  রবিযুগে যেমন ফণিভূষণের ভূত পাঠক-দর্শক-শ্রোতাকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছিলো, আজকের হাল জমানায় মোজো স্টোরি টেলাররাও নিজের হাতের মোবাইল ফোনে গল্প বলছে। যার নাম মোজো স্টোরি টেলিং মেথড। 

কিন্তু গল্প বলা কি আর চাট্টিখানি কথা? গল্পের প্লট দরকার, দরকার নাটকীয়তা, থাকতে হবে কাহিনীর বাঁক, আরো থাকবে রহস্যের মোড়। যেহেতু গল্পের ‘অভাগা ফণিভূষণ আধুনিক সভ্যতার কল হইতে অত্যন্ত ভালোমানুষটি হইয়া বাহির হইয়া আসিয়াছিল’, সেহেতু আজকের ফণিভূষণ তথা মোজো স্টোরি টেলারদের জন্য কিছু কৌশল হাজির করেছেন দুই সোশ্যাল মিডিয়া গবেষক ও সাংবাদিক। ফণিভূষণের কপালে যেমন জটিল এবং বহুবিস্তৃত একটা ফাঁড়া উপস্থিত হয়েছিলো, আমার ক্ষেত্রেও তাই। যোগ্য মনে করে লেখকদ্বয় কর্তৃক তিন কপি বই সডাকে উপস্থিত হয়েছে এই করোনাকালে। বইটি হাতে পেয়ে কী যে ভালো লেগেছে, তা গল্পের ফণিভূষণের মতো ‘ব্যাপারটা কী তাহা আমার মতো অব্যবসায়ীর পক্ষে বোঝা এবং বোঝানো শক্ত’। তবুও চেষ্টা করি বলতে। 

ম্যানুয়াল মতে, একজন সাংবাদিক, যিনি স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট পিসির মতো ইলেকট্রনিকস প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও প্রচারের কাজ করে থাকেন, তাকেই ‘মোবাইল সাংবাদিক’ বা সংক্ষেপে মোজো বলা হয়। এমন সময় ম্যানুয়ালটি প্রকাশ হয়, যখন কোভিড-১৯ অতিমারিতে মানুষ অনেক বেশি ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম নির্ভর হয়েছে। অন্তত ২০১৯ সালেও যারা অনলাইনের বিচিত্র জগত থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে চেয়েছেন, তারাও বুঁদ হয়েছেন করোনাকালের নিস্তরঙ্গ অবসাদের জীবনে। যারা এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোনকে এক ধরনের বিলাসিতা বলে মনে করতেন, ২০২০ সালে মহামারি ত্রাসে  পুরোদস্তুর তারাও খুলেছেন হোয়াটসএপ, ফেসবুক, ইউটিউব একাউন্ট। অর্থাৎ, আজ গল্পের ‘ফণিভূষণের হৃদয় ব্যাকুল এবং সর্বাঙ্গ কণ্টকিত হইয়া উঠিল’ দশা আমাদের সকলের। আমরা এখন ছাদ থেকে, গৃহবন্দী কোণা থেকে, সিঁড়ি থেকে, বারান্দা থেকে নানান ভিডিও কনটেন্ট আপলোড করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। করোনা না এলে চারদিকে এত গান, নাচ, অভিনয়, মিমসের প্রতিভা কি এত সহজে প্রকাশ হতো? কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া কি যা খুশি তা প্রকাশ করার স্থান? প্রকাশিত ম্যানুয়ালটি বলছে- ‘না’। ‘নয়া মাধ্যম প্রযুক্তি’ নিয়ে এসেছে ‘নয়া এথিক্স’র বার্তাও। মোবাইল সাংবাদিকতায় পেশাদার সাংবাদিকদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলায় এই প্রথম প্রকাশিত হলো ‘সোশ্যাল মোবাইল জার্নালিজম’ শিরোনামে ম্যানুয়ালটি। এতে দুই ধরণের আলাপ আছে। সংবাদকর্মীদের সোশ্যাল মিডিয়া ও মোবাইল সাংবাদিকতায় কী কী দক্ষতা প্রয়োজন আর সাংবাদিকতার নৈতিকতার মানদণ্ডে কীভাবে একজন সাংবাদিক বা মোজো স্টোরি টেলার তার গল্পটি বলবেন, সেটি। এছাড়াও সহজবোধ্য বর্ণনায় আরো আছে কোন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে মোজো রিপোর্টে ইত্যাদি ইত্যাদি। 

আনন্দের খবর এই যে, বইটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল ফোন আউটলেট নিউজরুম ও অনলাইন গণমাধ্যম ‘বাংলাদেশ টাইমস’–এর জন্মক্ষণের প্রসববেদনায়। ম্যানুয়ালটি লিখেছেন ড. কাবিল খান জামিল ও সাব্বির আহমেদ। প্রথম লেখক ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) মিডিয়া স্টাডিজ ও জার্নালিজম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। দ্বিতীয়জন এক দশক ধরে দেশের মোবাইল সাংবাদিকতায় যুক্ত। তিনি ‘বাংলাদেশ টাইমস’এর লিড মোবাইল জার্নালিস্ট। এখন পাঠক বা দর্শকের কাছে আমার কৌতুহল নিবারণের পালা। এই দুই স্রষ্টা কোন সত্য নিয়ে হাজির হয়েছেন এবং কেন, এই প্রশ্নের সুরাহা করাটা জরুরি। ৬২ পৃষ্ঠা সম্বলিত ম্যানুয়ালটির প্রকাশিত হয় চলতি বছরের মে মাসে। এর প্রকাশক স্বনামধন্য উদ্যোক্তা আবেদ মনসুর এবং পরিবেশনা করছে উৎস প্রকাশন। ১২টি অধ্যায়ে বিভক্ত এই ম্যানুয়ালে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে নিউজ কনটেন্ট তৈরির ওপর। মানুষ যেহেতু এখন অনেক বেশি সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয়, সুতরাং কোন ফরম্যাটে কিভাবে নিউজ প্রকাশ করতে হয় সে বিষয়গুলোর অনুপুঙ্খ বর্ণনা আছে এতে। সুদৃশ্য মলাট নয় শুধু, বহুমূল্যের লেমিনেটেড পেপারে এমন দারুণ একটি ছাপা বই হাতে নিয়ে দেখেছি বহু বছর পর। আমাদের দেশে সাধারণত বিদেশি দাতা সংস্থার অর্থায়নে এইধরণের বহু প্রকাশনাকে অর্থহীন প্রকল্পের অংশ হিসেবে দেখলেও, এই বইটি আকার ও আধেয়গত কারণে তার বিশিষ্টতা প্রমাণ করেছে। বিশ্বের সর্বশেষ মোবাইল সাংবাদিকতার টুলসের বর্ণনা যেমন এতে আছে আরো আছে প্রযুক্তিগত সুবিধাগুলো কিভাবে সহজে পাওয়া যাবে তার বর্ণনা। নির্ভুল ছাপা, পৃষ্ঠাসজ্জায় চমৎকারিত্ব এবং রঙের ব্যবহারে পরিমিতিবোধ এই প্রকাশনার রুচিগত বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে।

ম্যানুয়ালটি এসেছে এমন এক সময়, যখন দেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের মতে (স্মার্টফোনে স্মার্ট বাংলাদেশ, সমকাল, ২১ এপ্রিল ২০২১), ‘‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রযুক্তিবান্ধব নীতি ও নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তবতা। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য একটা বড় পরিকল্পনা ছিল প্রযুক্তিপণ্যে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠিত করা। স্মার্টফোন এবং ফিচার ফোনে তা সম্ভব হয়েছে।.. ২০১৯ সালে ৭৬ লাখ স্মার্টফোন বিক্রি হয়। এর মধ্যে প্রায় ৪৭ লাখ বা ৬২ শতাংশ ছিল দেশে তৈরি। ২০২০ সালে এসে স্মার্টফোনের বিক্রি যেমন বেড়েছে, তেমনি দেশে উৎপাদনও বেড়েছে। এখন পর্যন্ত দেশে মোট ফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩৫ শতাংশ। বাকি ৬৫ শতাংশ বেসিক ফোন ব্যবহার করছেন।’’ ফলে সোশ্যাল মিডিয়া ও মোবাইল প্রযুক্তির এই সময়ে সাংবাদিকতার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বই এটি। ম্যানুয়ালটিতে সোশ্যাল প্লাটফর্মে লাইভ স্ট্রিমিং, সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ভিডিও এডিটিং, সাংবাদিকতায় যেসব মোবাইল অ্যাপস এর প্রয়োজন , সবমিলিয়ে ডিজিটাল স্টোরিটেলিং করার পদ্ধতি এবং এজন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি  যা লাগবে তাঁর বিবরণ দেয়া হয়েছে। 

ছোট্ট একটি মেদহীন দরকারি কথার ‘ভূমিকা’ দিয়ে চমৎকারভাবে লেখকদ্বয় নানান কৌতুহল ও প্রশ্নকে সামনে রেখে আগাতে শুরু করলেন। প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম- ‘বদলে যাওয়া সাংবাদিকতা’। ১২ পৃষ্ঠার লেখায় এখানে আছে মোবাইল ফোন এসে কিভাবে বদলে গেলো সাংবাদিকতার চেহারা সেটি। এরপর মোজো সম্পর্কে ছোট্ট একটি সংজ্ঞাভিত্তিক আলোচনা আছে দ্বিতীয় অধ্যায় ‘মোবাইল সাংবাদিকতা কী’ এতে। তারপর যথারীতি অধ্যায়গুলো আগায় এই শিরোনামে- ‘মোবাইল সাংবাদিকতার উপকারিতা’, ‘মোবাইল সাংবাদিকতার কর্মপ্রবাহ ও পরিকল্পনা’, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিজ্যুয়েল গল্প তৈরির কৌশল’। এতদূর পর্যন্ত এসে ম্যানুয়েলটি বাঁক খায় হালকা করে। কারণ এর পরের অধ্যায়টি ‘সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লাইভ স্ট্রিমিং’, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি দিক। বিশেষ করে ঘাড়ের ওপর ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট রেখে হাতের উপর লাইভ সাংবাদিকতা করা কি চাট্টিখানি কথা? সম্প্রচারে একটু উনিশ-বিশ হলেই ‘দরজায় ঠক ঠক’ করারও সময় দিবে না আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। অধ্যায়টি লাইভ স্ট্রিমিংয়ের সময় পেশাগত দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ থাকতে বলে আমাদের। এরপর রয়েছে সম্পাদনার আলোচনা, যা মোজোর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। এই অধ্যায়টির নাম ‘সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ভিডিও এডিটিং’। তারপরের অধ্যায়টি ‘প্রতিবেদন তৈরিতে মোবাইল অ্যাপসের ব্যবহার’ নিয়ে। অর্থাৎ কোন কোন অ্যাপস ব্যবহার করে আপনি আপনার ফোনে কাজ করবেন তার সচিত্র বিবরণ ও ঠিকুজি। এরপরের অধ্যায়টি ‘ডিজিটাল স্টোরি টেলিং’। যদিও আমার কাছে মনে হয়েছে এটি অধ্যায়কে বাড়ানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, এটি সম্পাদনা অধ্যায়েরই সহগামী আলোচনা। তারপরের অধ্যায়টি ‘সোশ্যাল স্টোরিজ: গণমাধ্যমের জন্য নতুন সম্ভাবনা’, এতে বলা হয়েছে কিভাবে নয়ামাধ্যম প্রযুক্তি নতুন সম্ভাবনা হাজির করতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। সবশেষে রয়েছে এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ‘মোবাইল সাংবাদিকতায় নীতি-নৈতিকতার ব্যবহার’। একজন প্রাক্তন সংবাদকর্মী, বর্তমানে সাংবাদিকতার শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে এই অধ্যায়টি আমার কাছে নানাবিধ কৌতুহলের জন্ম দিয়েছে। কারণ, আমরা মোজোর কারিগরি দিক নিয়ে যতটা উৎসাহ দেখাই, নীতিগত দিক নিয়ে ততটাই অবহেলা দেখাই। আমরা যেন গুণগত মানের চেয়ে পরিমানগত মানের দিকে বেশি ঝুঁকছি। প্রথাগত সাংবাদিকতার কিছু নৈতিকতার আলাপ নতুন প্রযুক্তিযুগে এসে যে নবায়ন করার সময় এসেছে, তা যেন বুঝেও না বোঝার ভান ধরেছি। হাতের কাছে ফোন আর তাতে ডাটা থাকলেই যা খুশি তা ‘লাইভ’ করার নৈতিকবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে আজ। এসব আলোচনাকে সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন দুই তরুণ গবেষক এবং লিড মোবাইল জার্নালিস্ট। তবে এই দুই লেখকের প্রতি প্রত্যাশা আরেকটু বেশি ছিলো। নয়া মাধ্যম প্রযুক্তির যুগে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতাই যেখানে প্রাধান্য পাওয়ার কথা, সেখানে ৬২ পৃষ্ঠার মধ্যে মাত্র তিন পৃষ্ঠার এই আলোচনা বোধহয় যথাযথ হয়নি। ইতিবাচকভাবে বললে, ‘জানিবার আরো বোধ’ জাগ্রত করেই অতৃপ্ত রাখলেন তাঁরা আমাদের।
    
ম্যানুয়েলটি দুইবার পড়ে ও একাধিকবার উল্টেপাল্টে দেখে কয়েকটি কথা মনে হলো। আজকাল শুধু ছোট্ট একটি নিউজই নয়, অনেক বড় বড় কাজই হচ্ছে স্মার্টফোন দিয়ে। পশ্চিমা বিশ্বের বহু গণমাধ্যমের বার্তাকক্ষ চলছে মোবাইল ফোনের ভরসায়। বিবিসি, আলজাজিরা, এনডিটিভিসহ লিড মিডিয়া স্টেশনের কর্মীরা মোবাইল ফোনেই সারছেন নিত্য কাজ। ফলে বাংলাভাষী সাংবাদিকতার পেশায় স্মার্টফোনের সঠিক ব্যবহার এবং এই কাজে ব্যবহারের উপযোগী অ্যাপ ও আনুষঙ্গিক উপকরণের বিশদ আলোচনায় এই প্রকাশনাটি একটি দারুণ আয়োজন। ইউরোপ-আমেরিকার পর বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যে মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজমের ওপর কোর্স চালু হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২৫ বছরের ইতিহাসে এবছরই প্রথম তৃতীয় বর্ষে মাল্টিমিডিয়া এডিটিং কোর্স চালু হয়েছে এবং তাতে আমার সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমি সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের সমসাময়িক বাংলাদেশ ও গণম্যাধম কোর্সে ‘কারেন্ট ট্রেন্ড’ টপিকে মোজো পড়িয়েছি এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে করোনাকালে দারুণ সব এসাইনমেন্ট পেয়েছি। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এই প্রথম কোন সাংবাদিকতা বিভাগের খুদে শিক্ষার্থীদের এসাইনমেন্ট দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও শীর্ষস্থানীয় টিভি স্টেশন ‘চ্যানেল আই অনলাইন’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে। এতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন কাজ করার দক্ষতা সৃষ্টি হয়, তেমনি আত্মবিশ্বাসেরও জন্ম নেয়। আমি নিজে মোবাইল সাংবাদিকতার ওপর কোর্স পড়াতে গিয়ে দেখেছি বাংলায় এই ধরণের একটি ম্যানুয়েল খুব দরকার ছিলো। এছাড়াও বাংলাদেশে মোবাইল সাংবাদিকতা চর্চার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এখনো তা পুরোপুরি বিকাশ লাভ করতে পারেনি। খোদ গণমাধ্যমকর্মীদের কাছেও তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি নতুন ধারার এই সাংবাদিকতা। এই ম্যানুয়েলটি সেই শূণ্যতা পূরণ করতে পারবে বলে মনে করি।

কেবল প্রশংসাগীতি করেই কি লেখার ইতি টানবো? না। অধ্যায়গুলোতে আলোচনা যতটা চমৎকার হয়েছে, বিপরীতে শিরোনামগুলো যেন নিষ্প্রাণ, কাঠিণ্যে ভরা। আরো প্রাণবন্ত ও সৃজনশীল শিরোনাম বইটির প্রতি পাঠককে মুগ্ধ করতে পারতো। যার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে। আমরা জানি, একটি শিরোনাম হলো সেই রচনায় প্রবেশের দরজা। ফলে সৃজনশীল শব্দচয়নের মাধ্যমে অধ্যায়গুলো পাঠকের চোখকে আরো দারুণকরে কাছে টানতে পারতো বলে মনে করি।

প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ যদি ধৈর্য ধরে যদি এই লেখাটি পড়ে থাকেন, তাহলে ম্যানুয়েলটির প্রতি আপনার মনে হয়তো কৌতুহল তৈরি হয়েছে। মণিহারা’য় ভূতের কাহিনীর আড়ালে রবীন্দ্রনাথ যেমন পুরুষদের কানে মন্ত্রণা দিয়েছিলেন- স্ত্রীর ওপর একটু অধিকার চর্চা করার। এই বইটিও যেন হাল আমলের ফণিভূষণের মতো পরামর্শ দিচ্ছে- মোবাইল ফোনটির ওপর নিজের অধিকার চর্চা করার। নয়তো, এই যন্ত্রটি যেকোন সময় হয়ে উঠতে পারে যন্ত্রণা।

রবি ঠাকুরের গল্পটি শেষ হয় দুজনের কথোপকথনে, এভাবে- আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি এ গল্প বিশ্বাস করিলেন না।” আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি কি ইহা বিশ্বাস করেন।” প্রিয় পাঠক, মাত্র দেড়শ টাকায় মোজো ম্যানুয়ালটি কিনে বিশ্বাস করুন, কথা দিলাম- ঠকবেন না। কারণ, শ্বাস বার বার, বিশ্বাস একবার। মণিহারা’র ফণিভূষণের মতো গল্প বলে শ্রোতা ধরে রাখতে পারে কয়জন? মোবাইল ‘ফোন’কে ‘ভূষণ’ অর্থাৎ অলঙ্কার হিসেবে হাতে রেখে যিনি চমৎকার ‘গল্প’ (ডিজিটাল স্টোরি ম্যাকিং) বলতে জানেন, তিনিই এই যুগের ফণিভূষণ!    

লেখক: রাজীব নন্দী, সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাল্টিমিডিয়া একটিভিস্ট। এই লেখার প্রতিক্রিয়া কিংবা লেখকের সাথে যোগাযোগে ইমেইল: [email protected]

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank