বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: শতবর্ষের আলোকে

শারফিন শাহ

১৪:৫৫, ২ জুলাই ২০২১

আপডেট: ১৪:৫৬, ২ জুলাই ২০২১

৫৯২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: শতবর্ষের আলোকে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত যেকোন আলাপেই অধিকাংশ পাঠক বিরক্ত হন। এ বিদ্যায়তনের অতীতের গৌরব অনুস্মরণ করলে এক শ্রেণির কাছে তা কল্পকথা বলে গণ্য হয়; বর্তমানের রুগ্নদশা তুলে ধরলেও আরেক শ্রেণি বলেন, এসব গান আর কত! এদিকে আবার খোদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের জারিকৃত বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, কোন সমালোচনাকেই তারা হাসিমুখে মেনে নেবেন না। ফলে কি-বোর্ড চালাতে গিয়ে দোটানায় পড়তে হয়। কি লিখব তার একটা সীমানা নির্ধারণ না করলে চলেনা।

যারা বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিকথা 'আমার যৌবন', গল্প 'আবছায়া' এবং আহমদ ছফার 'গাভী বিত্তান্ত', 'পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ' উপন্যাসদ্বয় পড়েছেন তাদের পক্ষে সহজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকাল ও একালের পার্থক্য নির্ণয় করা সহজ। বুদ্ধদেবের ছাত্রজীবনে, রমণীয় রমনার কোলে, ভেতরে বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জমকালো এক ব্যাপার হলেও; তাতে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, মনোরঞ্জনী উপচার আর সুরম্য লাইব্রেরি থাকলেও, আহমদ ছফার বেলায় সে চিত্র নেই। তাঁর চোখে ফোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটা প্রকৃতিবিরোধী, জ্ঞানশূন্য ও নির্দয়। নির্মোহভাবে দেখলে ছফার বর্ণনাই একালের ক্ষেত্রে সর্বৈব সত্য। 

বস্তুত এ বিদ্যাপীঠের যে ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করা হয় তার কোনো গভীর তাৎপর্য নেই। গবেষণা, জ্ঞান উৎপাদন, আবিষ্কারে যতটুকু অবদান রাখার কথা ছিল এ প্রতিষ্ঠান তাতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশভাগের পূর্বে বিশ্বমানের জ্ঞানচর্চার যে ধারা সূচিত হয়েছিল পরবর্তীতে তা আর অটুট থাকেনি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূতিকাগারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক উৎকর্ষ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছে। তবু পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ছিল অনেকটাই জ্ঞানমুখী। কিছু কৃতবিদ্য শিক্ষক যেমন আবদুর রাজ্জাক, মুনীর চৌধুরী, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী লাইব্রেরিতে প্রচুর সময় কাটানোর সুবাদে 'লাইব্রেরির বাসিন্দা' হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তখনকার বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ছিলো আশাব্যঞ্জক। চীন, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, নেপাল, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া থেকে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী পড়তে আসতো। সামরিক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেও শিক্ষক-প্রশাসকরা তাঁদের সিদ্ধান্তে অটল থাকতেন। উপাচার্যরা নিজেদের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার্থে ক্ষমতাবানদের পোঁ ধরে থাকতেন না। আর এসবকিছু পর্যবেক্ষণ করেই সম্ভবত আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, 'একাডেমিকভাবে অন্তত পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত চাই।' 

শতবর্ষের শুভলগ্নে আনিসুজ্জামানের দাবিটি পুনর্বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা আছে। কারণ উচ্চশিক্ষার ভিত্তি নির্মাণ, নারীশিক্ষার পথ উন্মুক্তকরণ, বুদ্ধিবৃত্তিক, ইহজাগতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা সঞ্চার, সর্বোপরি বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয় রেখেছে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা। দেশের বর্ষীয়ান সাহিত্যিক, সাংবাদিক রাজনীতিক, সংগঠক, সংস্কৃতি সাধকদের সিংহভাগই এখান থেকে বিকষিত হয়েছেন। রাজনৈতিক অরাজকতার মধ্যেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে সাফল্যের কেতন উড়িয়ে চলেছেন। এতোটা অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, জনবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয়ও পৃথিবীতে বিরল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আছে। এখন শুধু একাডেমিক গৌরব ফিরিয়ে আনলেই ষোলোকলা পূর্ণ হবে। যদি অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার জ্ঞাননির্ভর সোনালি অতীত ফিরে না পায় তবে আমরা আত্মবিস্মৃত ও অকৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে আবারও যে বিশ্বজোড়া খ্যাতিলাভ করব, তাতে সন্দেহ নেই। 

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank