শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৫ চৈত্র ১৪৩০ || ১৭ রমজান ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

স্বপ্ন ছোঁয়ার আশায় বাংলাদেশিদের ইউরোপমুখী প্রাণান্তকর চেষ্টা

বিপ্লব শাহরিয়ার, প্রবাসী সাংবাদিক

০৬:১০, ২০ মে ২০২১

আপডেট: ১৬:৪৯, ২০ মে ২০২১

৭৬৬

স্বপ্ন ছোঁয়ার আশায় বাংলাদেশিদের ইউরোপমুখী প্রাণান্তকর চেষ্টা

জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে তারা সাগরে ভাসে
জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে তারা সাগরে ভাসে

ঘটনা-১:
গেলো ১৮মে ভূমধ্যসাগরে একটি নৌকাডুবির ঘটনায় ৩৩ জন অভিবাসন প্রত্যাশীকে উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, এদের সবাই বাংলাদেশি। লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ার দক্ষিণ উপকূলের কাছে ডুবে যায় নৌকাটি।জীবিতরা একটি তেল স্থাপনা আঁকড়ে ধরেছিলেন। সেখান থেকে তাঁদের উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিখোঁজ অর্ধশতাধিক মানুষ কোন দেশের নাগরিক, তা এখনো জানা যায়নি।

ঘটনা-২:
গেলো ৭ এবং ৮ মে, দুইদিনে দুই হাজারের বেশি অবৈধ অভিবাসী অবতরণ করেন ইতালির লাম্পেডুসা দ্বীপে। যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি। চলতি বছরে এ পর্যন্ত একদিনের হিসেবে ৮ মে ইতালিতে পা রাখেন সর্বোচ্চ সংখ্যক অভিবাসী। তিউনিসিয়া, আইভোরিকোস্ট এবং বাংলাদেশের প্রায এক হাজার ৪০০ অভিবাসী ওইদিন লাম্পেডুসা দ্বীপে পৌঁছান। সিসিলির স্থানীয় পত্রিকা গিওরনালেদি সিসিলিয়ার দাবি, মাত্র ২৪ ঘণ্টায় অভিবাসীবাহী ২০টি নৌকা নথিভুক্ত করেছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।এসব নৌকায় আসা দুই হাজার ১২৮ জনকে স্থানীয় আশ্রয় প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়।


স্বপ্ন ছুঁতে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ
কেবল বাংলাদেশ নয়, ইউরোপ সম্পর্কে নানা কল্পকাহিনী ছড়িয়ে আছে আফ্রিকা, মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে।সেই কল্পকাহিনীর ফাঁদে পড়ে ইইউরোপগামী ভয়ঙ্কর আর অনিশ্চিত যাত্রাপথে পা বাড়াচ্ছেন বাংলাদেশিরা।

ইউরোপে বিশেষ করে ইতালি এবং গ্রিসে পৌঁছাতে পারলেই মোটা বেতনের কাজ, সঙ্গে আরাম-আয়েশের জীবন। এমন একটা ধারণায় বিভ্রান্ত বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকার মানুষ। স্বল্পশিক্ষিত কিংবা একেবারেই অশিক্ষিত এই মানুষগুলোর মধ্যে এমন ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য এবং তাদের দালালরা। ইউরোপ কিংবা বাংলাদেশে থেকেই কাজ করছে এই চক্রটি।সাধারণ মানুষ তাদের বিশ্বাসও করছেন। চক্রটি মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে যে, একবার ইউরোপে ঢুকতে পারলে কেবল দারিদ্রই ঘুচবেনা, ধনী হয়ে যাবেন তারা।

ইউরোপিয় কমিশনের তথ্য মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শূণ্য দশমিক পাঁচ শতাংশই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী বা অভিবাসী হিসেবে অবস্থান করছেন। যার সংখ্যা আট লাখ ৫৪ হাজার ৭৮২ জন। ২০১৯ সালে ১৩ হাজার ১৯০ জন বাংলাদেশি ইউরোপে আশ্রয় প্রার্থণা করেছেন। যা মোট আশ্রয়প্রার্থীর ২.১%।

কিন্তু অনেক বাংলাদেশি অভিবাসীর কাছেই বাস্তবতা ধরা দিয়েছে নির্মম এবং ভিন্নভাবে।পাচারকারী এক চক্রের কাছ থেকে তারা বিক্রি হয়ে গেছেন আরেক চক্রের কাছে। বাধ্য হচ্ছেন মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দিতে হচ্ছে প্রাণও।প্রাণ দিতে হচ্ছে ভূমধ্যসাগরে ডুবে। কিংবা স্থলপথে বসনিয়ার জঙ্গলে অসহনীয় ঠান্ডায় কিংবা না খেয়ে।চক্রগুলো কেবল বাংলাদেশ কিংবা লিবিয়া থেকেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে না। আরব আমিরাত এবং তুরস্কসহ বেশ কিছু দেশে রয়েছে তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক।

বিপদসংকুল পথে যাত্রা
বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার সরাসরি এবং সহজ কোনো পথ নেই। মূলত লিবিয়া, তুরস্ক এবং বসনিয়া হয়েই ঢুকতে হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে বেশিসংখ্যক মানুষ ব্যবহার করছে লিবিয়া এবং তুরস্ক হয়ে ভূমধ্যসাগরের বিপজ্জনক রুট দু'টি।অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর গবেষণা বলছে, সাতটি রুট দিয়ে ইউরোপে ঢুকছে মানুষ। এগুলোর মধ্যে তিনটি স্থল পথ।পশ্চিম বলকান অঞ্চল, আলবেনিয়া-গ্রিস বৃত্তাকার রুট এবং পূর্বাঞ্চলীয় স্থলসীমান্ত। সাগরপথে রয়েছে কৃষ্ণসাগর, পূর্ব-ভূমধ্যসাগর, মধ্য-ভূমধ্যসাগর এবং পশ্চিম-ভূমধ্যসাগর।

মৃত্যু ফাঁদ ভূমধ্যসাগর
মানব পাচারকারীদের কাছে সব থেকে পছন্দের রুট ভূমধ্যসাগর। এতে খরচ যেমন কম, সহজেই ফাঁকি দেয়া যায় কোস্টগার্ড সদস্যদের।এজন্য বেছে নেওয়া হয় রাতের অন্ধকার সময়টিকে। খারাপ আবহাওয়াতেও পরোয়া নেই তাদের।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয় সাগরে চলার অনুপযোগী কাঠের কিংবা রাবারের ছোট ডিঙ্গি নৌকা। একারণেই প্রাণহানীর আশঙ্কা থাকে সর্বোচ্চ।

জাতিসংঘের হিসেবে,  ২০২০ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছেন অন্তত এক হাজার ২০০ অভিবাসন প্রত্যাশী।আর চলতি বছর এখন পর্যন্ত প্রাণহানি ঘটেছে পাঁচ শতাধিক। এদের সবাই উত্তর আফ্রিকার উপকূল থেকে ইতালি ও মাল্টার উদ্দেশে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর হিসেব মতে, ২০১৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ অবৈধ অভিবাসী আশ্রয়ের খোঁজে ইতালিতে ঢুকেছেন। চলতি বছরের ৭ মে পর্যন্ত ঢুকেছে ১০ হাজার ৭২৫জন।

ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এই তালিকায় আছেন এক হাজার ২১৬ জন বাংলাদেশি। প্রসঙ্গত, এটি কেবল সাগর পথে আসা অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা।

বসনিয়া সীমান্তের 'বাঙ্গালি জঙ্গল'
স্থলপথে ইউরোপে ঢোকার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রবেশপথ বসনিয়া। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত শহর ভেলিকা ক্লেদুসা।এখানকার অবস্থা নিয়ে গেলো ২৬ এপ্রিল প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইনফো মাইগ্র্যান্টস। জানা গেছে সেখানকার একটি জঙ্গলের কথা।প্রায় ৫০ জন বাংলাদেশি মিলে একটি শিবির স্থাপন করেছেন সেখানে। এর নাম দেয়া হয়েছে 'বাঙ্গালি জঙ্গল'।সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ক্রোয়েশিয়ায় ঢোকার আগে নতুন করে জীবনী শক্তি ফিরে পেতে এখানে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তারা। এদের মধ্যে কেউ কেউ ক্রোয়েশিয়ায় ঢোকার একাধিক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।তবে হাল ছেড়ে দেন নি।

এদের কাছ থেকেই জানা যায়, সীমান্ত পাড়ি দিতে পারলে, প্রায় ১৮ কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথ শেষে পড়বে ক্রোয়েশীয় একটি গ্রাম।সেখানেই মিলবে বাস। যাওয়া যাবে যাগরেব পর্যন্ত। আরেকটি বাসে করে পৌঁছাতে পারবে স্লোভেনিয়া সীমান্তে।এরপর ২৫ কিলোমিটার হাঁটলেই দেখা মিলবে ইতালির। কিন্তু ইতালিতে ঢুকতে পারবে কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

ক্রোয়েশীয় পুলিশের বর্বর নির্যাতনের শিকার প্রায় সবাই। সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করলেই তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয় উলঙ্গ করে।কেড়ে নেয়া হয় মোবাইল ফোন আর সঙ্গে থাকা অর্থ। এরপর শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরিয়ে ফেরত পাঠানো হয় বসনিয়ার ভেতরে।ক্রোয়েশিয় পুলিশ এতটাই নির্দয় যে, মাঝে মধ্যে নিজেরা নির্যাতন না চালিয়ে, অভিবাসীদেরই বাধ্য করে একে অপরকে আঘাত করতে।বেশির ভাগই আট থেকে দশ মাস ধরে এই জঙ্গলে অপেক্ষা করছেন। পাঁচ থেকে ছ'বার করে সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ। কিন্তু আবারো চেষ্টা করবেন।কারণ ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। এদের অনেকেই এসেছেন ভিটে বিক্রি করে। কিংবা ঋণ নিয়ে। তাই যে কোনো উপায়েই হোক, ইউরোপ তাদের পৌঁছাতেই হবে। খালি হাতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা নেই কারোরই। কিন্তু পৌঁছাতে পারবে কি তারা স্বপ্নের ইউরোপে?

বিপ্লব শাহরিয়ার: জার্মানপ্রবাসী সাংবাদিক

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank