বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ || ১১ বৈশাখ ১৪৩১ || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

‘গাহনাভিনয়’ তত্ত্বের নিরীক্ষা ও প্রয়োগ

মৈমনসিংহ-গীতিকা’র ‘চন্দ্রাবতী’র থিয়েটার প্রযোজনা ‘গীতি চন্দ্রাবতী’

ড. ইসলাম শফিক

২০:৩৮, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আপডেট: ১২:১৫, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

১৪০৩

‘গাহনাভিনয়’ তত্ত্বের নিরীক্ষা ও প্রয়োগ

মৈমনসিংহ-গীতিকা’র ‘চন্দ্রাবতী’র থিয়েটার প্রযোজনা ‘গীতি চন্দ্রাবতী’

‘গীতি চন্দ্রাবতী’ বাংলাদেশের থিয়েটার শিল্পধারার একটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। ‘সংস্কার নাট্যদল’র এটি সপ্তম প্রযোজনা। নাট্যদলটির অভিজ্ঞতা ও প্রতিষ্ঠাকালীন বয়স খুব বেশি দিনের নয়; তবে প্রয়োজনার সংখ্যা বিবেচনায় আবার কমও নয়। ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু হওয়া এই দলটি ইতোমধ্যে প্রায় এক যুগ সময়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। নাট্যদলটি ২০১৯ সালে মঞ্চে নিয়ে আসে নাট্যপ্রযোজনা ‘গীতি চন্দ্রাবতী’। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক। প্রদর্শনীর পরপরই থিয়েটার শিল্পের দর্শক, নাট্যজন, নাট্যতাত্ত্বিক, নাট্যসমালোচক, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সুধিমহলে ব্যাপকভাবে আলোড়ন তৈরি করে। এই আলোড়নের মূলে কোন তারকা শিল্পীর অভিনয় বা অধিক বাজেটের সেট, লাইট, কস্টিউম, মেকআপ, প্রপস্ বা প্রযুক্তিগত উপস্থপনা নয়। তাহলে কী সেই অদৃশ্য শক্তি বা  ক্ষমতা যা মিলনায়তেনর উপস্থিত দর্শককে ভাব-বিমোক্ষণে সিক্ত করেছে  এবং নাট্যশাস্ত্রের মানুষদের ভাবনার জগতে রেখাপাত করেছে। মূলত ‘গীতি চন্দ্রাবতী’ নাট্যপ্রযোজনার নাট্যনির্মাণ কাঠামো ও পরিবেশনা রীতি এই প্রযোজনার অদৃশ্য প্রাণভোমরা। প্রযোজনায় অনুসৃত এই আঙ্গিককে নির্দেশক ‘গাহনাভিনয়’ অভিধা বা পরিভাষায় অভিহিত করেছেন। ‘গীতি চন্দ্রাবতী’ নাট্যপ্রযোজনায় অনুসৃত ‘গাহনাভিনয়’ তত্ত্বের নিরীক্ষণধর্মী প্রয়োগ বক্ষ্যমাণ পর্যালোচনার বিষয়। 

নাট্যকাহিনীর প্রধান চরিত্রের শেকড় সন্ধান
প্রথমেই নাট্যকাহিনীর মূল বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। ‘গীতি চন্দ্রাবতী’ মূলত শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’র অন্তর্গত মধ্যযুগের অন্যতম কবি নয়নচাঁদ ঘোষ রচিত ‘চন্দ্রাবতী’ আখ্যান থেকে নেয়া হয়েছে। নাটকের প্রধান চরিত্র চন্দ্রাবতী; তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত পুরো নাট্যঘটনা। তাঁর পিতা মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা দ্বিজ বংশীদাস ভট্টাচার্য এবং মাতার সুলোচনা বা অঞ্জনা৷ ড. দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, চন্দ্রাবতী আনুমানিক ১৫৫০ সালে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ‘চন্দ্রাবতী’ ষোড়শ শতাব্দীর একজন কবি এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি প্রথম বাঙালি মহিলা কবি হিসেবে সমাদৃত৷ তাঁর জীবনগল্প নাটকের চেয়েও নাটকীয়, বেদনাসিক্ত কবিতার আল্পনায় আঁকা একটি ট্র্যাজিক চরিত্র। কবি চন্দ্রাবতীর শৈশব, বিদ্যাশিক্ষা, জীবনের প্রেমশোকগাথা, একনিষ্ঠতা, সৃজনপ্রতিভা প্রভৃতি মিলে তিনি লোকসমাজ ও সাহিত্যে কিংবদন্তি চরিত্ররূপে বহমান। ‘চন্দ্রাবতী’র কবিতা থেকে তাঁর মিতামহের নামও জানা যায়; তাঁর নাম ছিল যাদবানন্দ। কবি চন্দ্রাবতী রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্য আখ্যান হল- মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা ও রামায়ণ; যা তিনি সমাপ্ত করতে পারেন নি। এই বিদুষী নারী আনুমানিক ১৬০০ খিস্ট্রাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

চন্দ্রাবতী প্রসঙ্গে লোকগাঁথা
বাল্যকালে চন্দ্রাবতীর বন্ধু ও খেলার সাথী ছিলেন জয়ানন্দ বা জয়চন্দ্র চক্রবর্তী নামের এক অনাথ বালক৷পুষ্পবনে শিবপূজার ফুল তোলার সময় চন্দ্রার সঙ্গে জয়চন্দ্রের পরিচয় ও সখ্যতা ঘটে। তাঁরা একে অপরের প্রণয়াবদ্ধ হন। তাঁদের অভিভাবকদের সম্মতিতে তাঁদের বিবাহের দিনও ধার্য করা হয়। ইতোমধ্যে জয়ানন্দ স্থানীয় শাসনকর্তা বা কাজীর  মেয়ে আসমানীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।সৃষ্টি হয় ত্রিকোণ প্রেমের মারাত্মক জটিলতা। চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দ’র বিবাহের নির্ধারিত দিনেই কাজি সাহেব আশমানী ও জয়ানন্দকে বিয়ে দেন। নাম পরিবর্তন করে জয়নাল নাম গ্রহণ করতে হয় জয়ানন্দকে। ঘটনার আকস্মিকতায় চন্দ্রাবতী নিদারুণ আঘাত পান। এরপর শুরু হয় চন্দ্রাবতীর বিরহ-বিধুর জীবন৷ শোক বিহ্বলতা কাটাতে তিনি শিবসাধনায় আত্মনিবেদন করবেন। তাঁর পিতা দ্বিজ বংশীদাস ফুলেশ্বরী নদীর তীরে তার প্রার্থনার জন্য একটি শিব মন্দির নির্মাণ করে দেন। আর এরপর থেকে তিনি বাকি জীবন অতিবাহিত করেন একেবারে একা। কিশোরগঞ্জ সদর থানার কাঁচারী পাড়া গ্রামের ‘চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির’টি কালের ইতিহাস সাক্ষী হয়ে ট্র্যাজিক গল্প বলে যাচ্ছে।

‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’র নয়ানচাঁদ ঘোষ প্রণীত চন্দ্রাবতী
শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’র অন্যতম একটি আখ্যান কবি নয়নচাঁদ ঘোষ প্রণীত ‘চন্দ্রাবতী’। কবি চন্দ্রাবতীর ট্র্যাজিক প্রয়াণের পর মধ্যযুগের অন্যতম কবি নয়নচাঁদ ঘোষ রচনা করেন ‘চন্দ্রাবতী’ চরিতকথা। চন্দ্রাবতীর বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া প্রেমের বিয়োগান্তক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় এই পালায়। ১২টি অধ্যায়ে ৩৫৪টি ছত্রের এ লোকগাঁথাটি চন্দ্রাবতীর জীবনীর তথ্যভিত্তিক লিখিত প্রামাণ্য দলিল। কবি নয়নচাঁদ ঘোষ প্রণীত পালাগান ‘চন্দ্রাবতী’ থেকে জানা যায় কবি চন্দ্রাবতী ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাধারী ও সম্ভাবনাময় সাহিত্যিক। কৈশোরে চন্দ্রাবতী ও স্থানীয় এক ব্রাহ্মণ যুবক জয়ানন্দের মধ্যে মনের আদান-প্রদান হয়। তাদের এ ভালবাসার বিষয়টি চন্দ্রাবতীর পিতা দ্বিজ বংশীদাস মেনে নেন। কথা অনুযায়ী সামাজিকভাবে দুই পরিবারের সম্মতিতে জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিয়ের দিন নির্ধারিত হয়। সে বিয়ের আয়োজনও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ ঘটে যায় আরেক ঘটনা। আসমানি নামের এক  মুসলমান মেয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকেই বিবাহ করেন জয়ানন্দ। এই মর্মান্তিক খবরে চন্দ্রাবতী স্তম্ভিত হয়ে নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করেন। নিদারুণ আঘাতে মুষড়ে পড়া চন্দ্রাবতীকে বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য পিতা দ্বিজ বংশীদাস কন্যাকে শিবের নাম জপ করতে বলেন আর রামায়ণ লিখতে উপদেশ দেন। বিরহকাতর চন্দ্রাবতী পিতার কাছে দুটি প্রার্থনা করেন- একটি ফুলেশ্বরী নদীর তীরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা এবং অন্যটি চিরকুমারী থাকার বাসনা ব্যক্ত করেন। পিতা তাঁর দু’টি কামনাতেই সম্মত হলেন। পিতা দ্বিজ বংশীদাস কন্যার জন্য ফুলেশ্বরীর নদী তীরে নির্মাণ করলেন শিবমন্দির।কিছুকাল পর জয়ানন্দ অনুতপ্ত হয়ে আবার তার কাছে ফিরে এলেও চন্দ্রাবতী আর তার সাথে দেখা করেন নি। প্রত্যাখাত হয়ে জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর উদ্দেশ্যে মন্দিরের দ্বারে পত্র লিখে যান। চন্দ্রাবতী অনেক পরে মন্দির খুলে এ লেখা দেখতে পান। ওই লেখা ধুয়ে ফেলার জন্য চন্দ্রাবতী নদীর ঘাটে জল আনতে গিয়ে দেখেন আত্মঘাতী ও বিরহী জয়ানন্দের মৃতদেহ জলের উপর ভাসছে। জয়ানন্দের মৃত্যুতে চন্দ্রাবতী অন্তরে শোক ও মনোবেদনায় সমাপ্ত হয় নয়নচাঁদ ঘোষের আখ্যান পালার।

‘সংস্কার নাট্যদল’ প্রযোজিত ‘গীতি চন্দ্রাবতী’
‘সংস্কার নাট্যদল’ প্রযোজিত ‘গীতি চন্দ্রাবতী’ মঞ্চনাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন ইউসুফ হাসান অর্ক। পাণ্ডুলিপি নির্বাচনে তিনি সবসময় শেকড়সন্ধানী। অনেক ভেবে চিন্তে তিনি এ যাত্রায় হাত বাড়িয়েছিলেন শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’র দিকে। ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’ থেকে মধ্যযুগের অন্যতম কবি নয়নচাঁদ ঘোষ প্রণীত ‘চন্দ্রাবতী’র মূল পা-ুলিপির আখ্যানকাহিনী অক্ষুণ্ন রেখে নির্দেশক যুক্তির শক্তিতে নবরূপায়নের প্রযোজনে কিছু কিছু স্থানে সংযোজন ও বিয়োজন করেছেন। এক্ষেত্রে ক্ষিতিশ চন্দ্র মৌলিক সম্পাদিত ‘প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র কিছু সত্যঘটনার সাথে সংশ্লেষ করা হয়েছে। পাশাপাশি সমকালীন নাট্যকার ও অধ্যাপক আফসার আমহদ বিরচিত ‘চাঁদ ও চন্দ্রাবতী’ নাটকের সংলাপ ও চিন্তার ছায়া রয়েছে আলোচ্য প্রযোজনার গল্পগাঁথুনীতে। দ্বিজ বংশীদাস তনয়া চন্দ্রাবতী বয়োসন্ধিকালে তার শৈশবের সাথী জয়ানন্দের কাছ থেকে প্রেমপত্র পেয়ে মনে মনে তাকেই পতি হিসেবে কল্পনার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলো। কন্যার ইচ্ছানুয়ায়ী পিতা দ্বিজ বংশীদাস জয়ানন্দের সাথে চন্দ্রাবতী’র বিয়ের দিন ধার্য করেন। কিন্তু বিয়ের দিন শুভক্ষণ পেরিয়ে গেলেও বর আর আসে না। বিয়ের আসরেই চন্দ্রাবতী জানতে পারে, জয়ানন্দের আসমানী নামে এক মুসলিম নারীর সঙ্গে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। এ আঘাত শোকে পাথর করে দেয় চন্দ্রাবতীকে। শোকাতুর চন্দ্রাবতী জীবনে আর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। পিতার পরামর্শে করবে ধ্যানমগ্ন যোগিনী হয়ে ওঠেন। ‘রামায়ণ’র এর সীতার মনোবেদনা নিজের কষ্টের সমান্তরাল ভাবনায় এনে ‘সীতার বারমানি’ রচনায় মনোনিবেশ করেন। বছর তিনেক পর জয়ানন্দ তার ভুল বুঝতে পেরে, অনুশোচনায় ফিরে আসে। কিন্তু চন্দ্রাবতী তখন পরিপূর্ণ  যোগীর ধ্যানে মগ্ন। পার্থিব জগত-সংসারের কোন কিছুই আর তাকে স্পর্শ করতে পারেনা।

পরিবেশনাশৈলী
‘গীতি চন্দ্রাবতী’ নামকরণ থেকেই আভাস পাওয়া যায় যে প্রযোজনাটির আখ্যান বা পরিবেশনা গীতনির্ভর। নাটকটির নির্দেশন অধ্যাপক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতির একজন গবেষক, তাত্ত্বিক ও একাধারে মঞ্চের একজন প্রায়োগিক শিল্পী। প্রযোজনাটি গীতল সংলাপ, বর্ণনা, সঙ্গীত, কোরিওগ্রাফ ও নৃত্য সহযোগে মঞ্চাভিনয় হয়ে থাকে। চন্দ্রাবতী আখ্যানের এই মঞ্চভ্রমণ একটি সুর ও তালে যেন গ্রন্থিত। নাট্যপরিবেশনার সাথে যুক্ত কলাকুশলীবৃন্দ নিপুণ দক্ষতায় সেই সুর ও তালকে অক্ষুণ্ন রেখে মঞ্চে বিচরণ করছেন। গবেষক ও নাট্যনির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক এই অভিনয়রীতিকে ‘গাহনাভিনয়’ অভিধায় নতুন একটি নাট্যপরিভাষায় অভিহিত করেছেন। অভিনয়রীতির এই আঙ্গিকটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্যের প্রেরণালব্ধ আধুনিক বর্ণনাত্মক নাট্যাঙ্গিক। ‘গাহনাভিনয়’-এ চরিত্রাভিনয়ের ক্ষেত্রে এক ধরণের নিরীক্ষা রয়েছে; যেখানে চরিত্র নিজেই তদীয় মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা ও অবস্থানসহ নাট্যঘটনার নানাদিক বয়ান করে। গীতিনাট্য বা বর্ণনাত্মক নাট্যপরিবশেনার আঙ্গিক প্রেরণালব্ধ হলেও খানিক নিজস্বতা রয়েছে ‘গাহনাভিনয়’ পরিবেশনারীতিতে। এই পদ্ধতির অভিনয় রীতিতে গীতের প্রতাপেই চরিত্রগুলোর চরিত্রাভিনয়কে বিশেষায়িত করে তোলে। রস নিষ্পত্তির মূল অবলম্বন হিসেবে কাজ করে ‘গীত’। প্রযোজনা জুড়ে গীতের প্রতাপের কারণেই এর নামকরণ করা হয়েছে ‘গীতি চন্দ্রাবতী’। 

প্রযোজনার নেপথ্যে ও মঞ্চের কারিগর
মঞ্চ, সংগীত ও নাট্যনির্দেশনা ইউসুফ হাসান অর্ক। আলোক পরিকল্পনায় ছিলেন অম্লান বিশ্বাস, পোশাক পরিকল্পনায় আইরিন পারভিন লোপা, নাটকটির কোরিওগ্রাফি করেন শ্রাবন্তী গুপ্ত, প্রপ্স করেছেন এ কে আজাদ হাওলাদার। নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন মনামী ইসলাম কনক, বাপ্পী সাইফ, ফাতেমা তুজ জোহরা ইভা, আশিকুর রহমান, নাবা চৌধুরী, খন্দকার রাকিবুল হক, মাসুদ কবির, হুমায়রা তাবাসসুম নদী, শচীন ভট্টাচার্য্য, মেছবাহুর রহমান, জান্নাত তাসফিয়া বাঁধন, ইগিমি চাকমা, মোস্তফা জামান সৌরভ, উষ্মিতা চৌধুরী, নির্ঝর অধিকারী, মায়ান মাহমুদ, টুটুন চাকলাদার, মোস্তাফিজুর রহমান ও সানাউল্লা সান্টু।

প্রযোজনা পর্যালোচনা
‘গীতি চন্দ্রাবতী’ নাট্যপ্রযোজনার নাট্যনির্মাণ কাঠামোতে নির্দেশক ‘গাহনাভিনয়’ অভিধা নামক যে নতুন আধুনিক নাট্যাভিনয় পদ্ধতির প্রয়োগ করেছেন তা অত্যন্ত সুচারুরূপে সার্থকতা পেয়েছে। এই নাটকে চরিত্রাভিনয়কে এক ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। যা নির্দেশকের একাডেমিক গবেষণার প্রায়োগিক রূপ। চরিত্র নিজেই তার নানা ঘটনার বর্ণনা করেন এই নাট্যে। নয়ানচাঁদ ঘোষ প্রণীত ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’র চন্দ্রাবতী আখ্যানটির বিষয়ের দিক থেকে অত্যন্ত বিষাদময় আর আঙ্গিকগত দিক থেকে কাব্যময়, ছান্দিক ও গীতল। কাব্য, ছন্দময় ও গীতল এই ত্রয়ী আঙ্গিকের চলন নির্ভর পা-ুলিপির মঞ্চপরিবেশনার জন্য ‘গাহনাভিনয়’ অত্যন্ত কার্যকরী একটি অভিনয় পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে। সংলাপ, বর্ণনা ও অভিনয়ে গীতের যে সূক্ষাম সংমিশ্রণে প্রতাপ পরিলক্ষিত হয়েছে তা  বেশ সমৃদ্ধ ও পরিমিত। গীতের প্রতাপ থাকলেও তা কখনো অভিনয়কে ছাড়িয়ে যায়নি। নির্দেশক এক্ষেত্রে দক্ষতার সাক্ষর রেখেছেন। চন্দ্রাবতী চরিত্র যিনি অভিনয় করেছেন মনামী ইসলাম কনক; তার অভিনয় ও গীতের উপর যে প্রচণ্ড দখল সেই গুণের প্রশংসা করতেই হবে। ঢাকার মঞ্চে ‘গাহনাভিনয়’ আঙ্গিকের অভিনয়শিল্পীর সঙ্কট রয়েছে। থিয়েটারের বিজ্ঞজন ও দর্শকের প্রত্যাশা মনামী ইসলাম কনক সেই সঙ্কটসময়ের এক দ্যুতি। ইতোমধ্যে তিনি ‘গাহনাভিনয়’ অভিনয়ধারাটি বেশ হৃদয় দিয়ে রপ্ত করতে পেরেছেন। অসাধারণ দক্ষতা ও নিপুণতায় তিনি চন্দ্রাবতীকে এঁকেছেন। চন্দ্রাবতী’র শৈশব, বয়ঃসন্ধিকাল, প্রেম, বিরহ, যোগমগ্নতা, বিষাদ ও একাগ্রতার ট্র্যাজিক আর্তনাদের বাণী সুরের মূর্ছনায় তিনি বেঁধেছেন যেন স্বচ্ছজলের উপর আঁকা তৈলচিত্রের পোট্রেট। বাপ্পী সাইফ যিনি জয়ানন্দ চরিত্রে অভিনয় করেছেন; তিনি ‘চরিত্রাভিনয়’ ও ‘গাহনাভিনয়’ এই দুইধারা এক করতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। এই চেষ্টাটা দেখা যায়। দৃশ্যমান এই চেষ্টার দেয়ালের আড়াল জয়ানন্দ চরিত্রটিকে পরিপূর্ণতা প্রদানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। মঞ্চে তিনি বারবার একজন প্রাণপন চেষ্টারত নির্দেশকের অভিনেতার ভূমিকায় হাজির হয়েছেন।

নাটকের প্রতিটি সুর, বাদ্য ও আবহসঙ্গীত প্রযোজনার প্রাণভোমরা হিসেবে কাজ করেছে, কর্ণতুষ্টির পাশাপাশি সুরগুলো চিত্রকল্প হয়ে মঞ্চালোকের মতো অদৃশ্য থেকেও দৃশ্যমানতা পেয়েছে। পোশাক ও প্রপস পরিকল্পনা অদ্ভূত রকমের সুন্দর হয়েছে; চরিত্র, বয়স, সময়, কাল বিবেচনায় সমসাময়িক উপযোগি করার জন্য আখ্যানটির গল্পটিকে আজকের গল্প মনে হয়েছে। দর্শক নাট্যচরিত্রগুলোকে  অনেক চেনা বা চিরচেনা ও আপন ভাবতে  পেরেছে। মঞ্চ পরিকল্পনা বেশ দুর্বল ও আরোপিত। সেট দর্শককে নোটিশ করছে। দেয়ালগুলোর ক্যানভাস দুমড়ানো মুচড়ানো, অমসৃণ, অনান্দনিক! মনে হচ্ছিল দুর্বল অভিনয় বা কম্পোজিশনকে বিশেষ সহায়তা দেবার জন্য সেট পরিবর্তন করা হচ্ছে। মুভিং দেয়াল বিভাজন, স্টেজ ক্রদের মঞ্চে চলাচল, রূপক দেয়াল সেটিংস্ ও অপসারণ এগুলো পুরাতন থিয়েট্রিক্যাল বিন্যাস পদ্ধতি; যা অভিনয় ও গীতের সুর-ছন্দকে বাধাগ্রস্থ করে মন্থর করে দেয়। অর্কেস্ট্রাদলের প্রাযোগিক নৈপুণ্যতা অসাধারণ কিন্ত গীতিনির্ভর প্রযোজনার জন্য হয়তোবা সঙ্গীতদলকে অভিনয়মঞ্চের আপস্টেজে সার্বক্ষণিক অবস্থান করতে দেখা যায়। সঙ্গীতদলের অভিনয়মঞ্চে দৃশ্যমান অবস্থানের কারণে সঙ্গীতদলের নানারকম মুভমেন্ট, রেখা, রঙ ও ছায়ার জন্য সম্মুখভাগের অভিনেতার চলন ও কম্পোজিশন দর্শক ভিস্যুয়ালি কোনো একক ইমেজ তৈরি করতে পারছেন না। বারবার ইলিউশন ভেঙ্গে যাচ্ছে। চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দের শেষদৃশ্যের ট্র্যাজিক দৃশ্যকাব্য ও বিষাদের সুর দর্শক মনে গভীর রেখাপাত করে। দর্শকসারির অনেককেই চোখ মুছতে দেখা যায়। কান্না চেপে রেখে শিল্পী ও কলাকুশলীদের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে সম্মান জানিয়েছেন।  
 
শেষকথা 
নাট্য নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক ‘গাহনাভিনয়’ নিয়ে যে নিরীক্ষা করেছেন তাতে তিনি সফলভাবে একধাপ এগিয়ে গেলেন নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকসাহিত্যর আখ্যান নিয়ে ‘গীতি চন্দ্রাবতী’ প্রযোজনাটি মঞ্চে আনার জন্য সংস্কার নাট্যদল’কে সাধুবাদ জানাই। লোকসাহিত্য লোকসংস্কৃতির একটি জীবন্ত ধারা; একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিমণ্ডল ও সমাজমানসের কথা বলে। ধারণ করে পূর্ব পুরুষের নিজস্ব জীবনাচরণের ঐতিহ্য, আবেগ, চিন্তা ও মূল্যবোধকে। শেকড়ের সন্ধানে নিয়ে যায়; যোগাযোগ সেতু তৈরি করে বর্তমানের সাথে। বাঙলা ও বাঙালির নিজস্ব রুচি নির্মাণ ও মানসগঠনে ‘গীতি চন্দ্রাবতী’ প্রযোজনাটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। তরুণ প্রজন্মের দর্শকের সাথে ঐতিহ্যের  শেকড়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে আমাদের নাট্যমঞ্চে এধরণের প্রযোজনা আরও প্রয়োজন। 

ছবি: বারীণ ঘোষ

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank